ল্যান্স ক্লুজনার মাঝপথে ছেড়ে যেতে, সাদা স্নো-পাউডার মুখে নামলেন ডোনাল্ড। খেলছেন অল্প, মাপছেন বেশি। মাঝেমাঝে ফোঁস করছেন। কলকাতা শহর ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে বসে গেছে সাদাকালো টিভির সামনে। শ্রীনাথ আর বেঙ্কটেশ প্রসাদের সামনে ড্যারেল কালিনান (Daryll Cullinan) একাই, ধীর-স্থির। একদল মানুষের ধৈর্যের ঘুড়ি তখন আটকে গেছে মরচে ধরা আন্টেনায়। সেই আন্টেনা যা আমরা একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে পৌঁছে যেতাম কখনও ইডেন, কখনো ব্রিসবেন, কখনো ওয়ান্ডারার্স। আর মাত্র দুটো উইকেট, শ্রীনাথ প্রাণপণে ছুটে চলেছেন; ডোনাল্ড খোঁচা দিতে দিতেও দিচ্ছেন না। মেঘ করে এল। আসলে বাঘকে একবার বাগে পেলে মানুষ দেখাতে চায় ব্যাঘ্রসম ক্ষমতা, আমরাও শেষবেলায় এসে তেমনটাই বাগে পেয়ে গেলাম হ্যান্সি ক্রোনিয়ের দলটাকে। গলির মুখের দোকান থেকে রেডিওর নব ঘুরিয়ে কমেন্ট্রির ঘড়ঘড়ে অংশকে ছেঁটে দিতে চাইছে কেউ; জীবন থেকে অযাচিত অস্বস্তি এভাবেই বোধ হয় ছেঁটে ফেলতে চায় মানুষ। ইতস্তত ভাবে ঘুরতে থাকা পথিক ক্লাবঘরের জানলার পাশ দিয়ে এসে বোকা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করছে— 'কালিনান গেল?'
ছিয়ানব্বই-সাতানব্বই দক্ষিণ আফ্রিকা ট্যুরে সচিন ক্যাপ্টেন। প্রত্যাশিতভাবেই প্রথম দু টেস্টে হার। শেষ টেস্টে ওই একটা পালটা মার। লর্ডসে সৌরভের সেঞ্চুরি যে লড়াকু দ্রাবিড়কে ঢেকে দিয়েছিল, জোহানেসবার্গে সেই দ্রাবিড় যেন জানলা সারাই-এর মিস্ত্রি। ছেনি-হাতুড়ি আর শক্ত চোয়ালে বের করে আনলেন অব্যর্থ ফ্রন্টফুট, ডোনাল্ডের সামান্য এক্সট্রা বাউন্স ডেলিভারি শরীর বেঁকিয়ে একটা স্কোয়ার কাট মারলেন, পোলককে পুল করলেন, পল অ্যাডামসকে বিরক্ত করে বাধ্য করলেন নিজের রাস্তায় আনতে। সেঞ্চুরি। আমাদের বাঙালি পাড়া, যা কিনা আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে টেস্ট খেলার আগে লেপ মুড়ি দিয়ে বসত স্রেফ কিছু লড়াকু ফলক তুলে নিতে, তাদের কপালে এমন টেস্ট কমই জুটত। এই সিরিজের প্রথম ম্যাচেই যেমন সৌরভ করলেন লড়াকু ১৬, দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রাবিড়ের অতিমানবিক ২৭! খবরের কাগজ ষোলো কিংবা সাতাশের আগে লড়াকু, অতিমানবিকের মতো বিশেষণ বসালে আমরা যত্ন করে তুলে নিতাম বুকপকেটে। বাম জমানার লাল পাড়াগুলোয় তখন স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেয়াল। একদেয়ালে বাড়ি, কমন টিউবয়েল, তখনো ভেঙে যায়নি আমাদের একান্নবর্তী পাড়াগুলো। জোড়া ছাদে রাতে শুয়ে তারা গোনার মুহূর্তে আচমকা রেডিওতে বেজে ওঠে অনুরোধের আসর। অজয় জাদেজার পোস্টার সেঁটে আছে পলেস্তারা খসা ঘরের দেওয়ালে। সূর্যগ্রহণের আগে এক্স-রে প্লেট খোঁজার হুড়োহুড়ি, চুরানব্বই বিশ্বকাপে বেবেতোর সেলিব্রেশন নকল করছে পাড়ার দাদারা; ছাদ থেকে যে মেয়েটিকে তখন দেখা যেত, সকালের ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে তার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাচ্ছে চন্দনের বন থুড়ি মোড়ের মাথায়, লুকিয়ে, আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছে হাত, সবার আড়ালে। গণেশের দুধ খাওয়ার গল্প কাগজে ছাপতেই সে কাগজ নিয়ে টানাটানি পড়ল, একঝাঁক কৈশোর তখন 'সুপারহিট মোকাবিলায়' লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে মাধুরীর খোলাপিঠ, বড় সাজার প্রাণপণ চেষ্টায় প্রথম সুখটান, চিত্রহারের পাতা ছিঁড়ে লুকিয়ে রাখা— মধ্যবিত্ত বাড়িতে সবুজ শালিমার তেল, চেসমি গ্লিসারিনের মতো শীত পড়লেই এসে পড়ত অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে টেস্ট সিরিজগুলো। অবধারিত হার কিংবা লড়াকু ড্র-এর বিষাদখণ্ডকে আমরা কয়েক কোটি লোক ভেঙে ভেঙে নিয়ে জমিয়ে রাখতাম বুকের বাঁ-পাশে। যেমন কেপটাউনে আজহারের সেই বিখ্যাত ইনিংস, ছেষট্টি অলআইটের লজ্জা সবটুকুই যেন শুষে নিল নয়ের দশকের মনখারাপি বিকেল, ছেঁড়াঘুড়ি, রঙিন বলের মতো ওইটুকু সম্বলই সে আগলে রাখল বহুকাল।
'কালিনান গেল?'— এ প্রশ্নের ভেতর একদলা সময় যেন ভরে দিয়েছে কেউ। জোহানেসবার্গের ওই টেস্টেই জয়ের খুব কাছে একটিবার পৌঁছেছিলাম আমরা। কিন্তু ড্যারিল কালিনান যে গেলেন না। নয়ের দশকে ভারত আফ্রিকায় কোনো টেস্টম্যাচই জিততে পারেনি। অস্ট্রেলিয়াতেও একটার পর একটা লজ্জার হার। জয় আর হারের মাঝে যে কিছু হলদে দুপুর গড়াগড়ি খায়, যেখানে দু'দণ্ড জিরয়ে নিতে চায় আমাদের প্রিয় আলসেমি- তা যেন শিখিয়েছিল ওই নয়ের দশকের শীত, ওই বিদেশে ট্যুরগুলো...
পঁচিশ বছর পর এই আফ্রিকার মাটিতেই রীতিমতো দাদাগিরি করে প্রথম টেস্টটা জিতে গেল ভারত। কিন্তু পরের টেস্টটায় ডিন এলগার যেন একা কুম্ভে লড়ে ফোর্থ ইনিংসে ম্যাচটা বের করে নিলেন ভারতের হাত থেকে। সামনে ফাইনাল টেস্ট। আমরা আটকে গেছি অদৃশ্য জয়-পরাজয়ের বাইনারিতে। পণ্যায়িত বিশ্বের কাছে ভারত যেন নিজেকে ঝকঝকে করে তুলে এনেছে বিরাট কোহলির হাত ধরে। নয়ের দশকের সেই মালিন্যের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে স্মার্ট ভারত৷ পেশাদার ভারত। সেদিনের দ্রাবিড় কাঁচাপাকা চুল নিয়ে বসে আছেন ডাগআউটে। প্রতিটি লাল বলের ছোঁয়া ক্রিজ থেকে উপড়ে নিচ্ছে কিছু কাঁকড়, সেই স্মৃতির কাঁকড়ের ভেতর জেগে উঠছে সেদিনের সেই মধ্যবিত্ত পাড়াগুলো। শহর-মফস্সলের সে বসতভিটেগুলো ছেড়ে কবেই চলে গেছে সবাই, ভেঙেচুরে উঠে গেছে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়ি। সেদিনের কিশোর আজ মাঝবয়েসে, আড়চোখে দেখা সেই মেয়েরা কোথায় যে চলে গেছে, সেই ক্লাবঘরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে পেটমোটা ভাঙাচোরা টিভিখানা। শীতে ভারত বিদেশে টেস্ট খেলতে নামলে এই সব পাড়া টারায় আলো এসে পড়ে; ঘন নীল হয়ে আসা সন্ধের মুখে চিরলের বন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা জোনাকি হয়ে ওঠে আচমকাই। বিরাট কোহলি সিরিজ জিতে দেশে ফিরলে কত যে মাঝযৌবনের অবদমিত ইচ্ছে জিতে যাবে!
আরও পড়ুন
‘একবার বেঁচেছি দেবতা হয়ে’
ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন-
আরও পড়ুন
ঘরোয়া ক্রিকেটে অসামান্য রেকর্ড, তবু ব্রাত্য ‘ভারতের ব্র্যাডম্যান’ কার্তিক বসু
'যে বিকেলে জ্বর আসে
সেই বিকেলের মতো
তুমি এসে
দাঁড়িয়ে রয়েছো।'
আরও পড়ুন
৪৯ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক! আজও অক্ষত ১৮৭৭ সালের সেই রেকর্ড
ড্যারেল কালিনান সেদিন আউট হননি। আজও নয়ের দশকের সেই পাড়াগুলোয় জ্বরের বিকেল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মাঝে মাঝে আমরা ফিরে গিয়ে স্কোর দেখি, জানলা দিয়ে বোকার মতো হেসে জিজ্ঞেস করি— 'কালিনান গেল?'
ছবি – ছন্দক গুহ
Powered by Froala Editor