থ্রি বিলিয়ান হার্টবিটস। আজ্ঞে হ্যাঁ। এই আমাদের গড় আয়ু। কোথায় যেন পড়েছিলাম। মিনিটে ৭২ করে ধরলে, এবং গড় পঁচাত্তর বছর আয়ু ধরলে মানুষের হার্ট ঠিক এতবার ধুকপুক করে। কী? মাথার ভেতর একটা একটা ঘড়ির টিকটিক শুনতে পাচ্ছেন? মনে হচ্ছে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়? বিখ্যাত ফুটবল মনোস্তত্ব গবেষক প্যাট্রিক কোন আমাদের বলছেন, একজন ফুটবলারের মাথায় অবচেতনে ঘুরতে থাকে এমন একটি ঘড়ি, প্রতিটি মুহূর্তে সে অনুভব করতে থাকে নব্বইতম মিনিটে বাজা শেষ বাঁশিটিকে। তাঁর ফিনিশিং লাইন। খেলা শুরুর বাশি থেকে শেষ হওয়া অবধি তাঁর মেমারি স্পেস ওই চৌকো মাঠের বাইরের যাবতীয় পৃথিবীর কিসসাকে উপেক্ষা করে। থ্রি বিলিয়ান হার্টবিটকে এবার আমরা একটা চৌকো ফুটবলমাঠে নিয়ে আসি। নব্বই মিনিটের একটি ম্যাচকে আমাদের সামগ্রিক জীবনের একটি ডিফারেন্সিয়াল ফর্ম ধরলে একটি ফুটবল ম্যাচে গড়ে নয় থেকে সাড়ে নয় হাজার হার্টবিট বরাদ্দ থাকে একজন ফুটবলারের। কিন্তু এরকম গ্রাফে বাঁধা জীবনকে দেখতে কার ভাল লাগে বলুন তো?
লাগবে। সেই ভাল লাগার গল্পেই ঘুরে আসি এখন।
দিন কয়েক আগেই রিয়াল মাদ্রিদ আড়াই মিনিটের ব্যবধানে দু’দুটো গোল করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে দিল ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই জয় ঢুকে গেল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিরে আসার গল্পের তালিকায়। যারা আমারই মতন ইউরোপীয় ক্লাবফুটবলের পোকা তাঁরা জানেন, গত দুই দশকে ইউরোপীয় ক্লাবফুটবলে কামব্যাকের গল্প নেহাত কম নেই। আগের শতকের একেবারে শেষে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ও বায়ার্ন মিউনিখের বিখ্যাত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালটির কথাই ধরা যাক। বায়ার্নের ১-০ গোলের লিড টিকে ছিল খেলার নব্বই মিনিট অবধি। একানব্বই ও বিরানব্বইতম মিনিটে টিডি শেরিংহ্যাম ও ওলে গানার সোলজারের গোলে ঘটে যায় মিরাকেল। সে বছর ইউরোপীয় ট্রেবল ঘরে তোলে রেড ডেভিলসরা। একুশ শতকের প্রথম দশকে মিরাক্যাল অফ ইস্তানবুল তো বহুলচর্চিত। সে সময়ের অন্যতম সেরা দল মিলান ৩-০ গোলে এগিয়ে ছিল প্রথমার্ধে। দ্বিতীয়ার্ধে অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে আসে স্টিভেন জেরার্ডের লিভারপুল। আগের দশকে বার্সেলোনার রেমোন্তাডা, যেখানে ৮৭ মিনিট থেকে ৯৫ মিনিটের মধ্যে তিনটি গোল করে প্যারিস সেন্ট জার্মানকে হারিয়ে দেয় কাতালান দলটি। অদ্ভুতভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামগ্রিক ম্যাচের ধার্য সময়ের নিরিখে প্রায় দশভাগের একভাগ সময়ে একটি দল আচমকা ফিরে এসেছে, আর অন্যদলটি সুবিধাজনক জায়গা থেকে একেবারে উল্কার মতো পড়েছে মাটিতে। ম্যাঞ্চেস্টার সিটি ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম শক্তিধর দল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো প্রবল প্রতিযোগিতামূলক লিগে পেপ গুয়ার্দিওলা ও তাঁর দল বিগত দশকে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতে পেরেছে, অন্তত দশকের দ্বিতীয়ভাগে তো বটেই। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ম্যাচের নব্বই মিনিট অবধি তাঁরা দু’গোলে এগিয়ে ছিল দুই লেগ মিলে। অথচ, শেষ তিন মিনিটে উলটপুরাণ। আমদর্শকের স্নায়ুতে চোরাস্রোত বইয়ে কী যেন একটা ঘটে গেল!
অথচ রিয়াল মাদ্রিদের কাছে এ ঘটনা নতুন নয়। ঠিক আগের নকআউট ম্যাচেই চেলসির বিপক্ষে তারা ওই শেষ কয়েক মিনিটে গোল দিয়ে ফিরে এসেছে। তার আগের ম্যাচেও তারকা খচিত প্যারিস সেন্ট জার্মানের বিরুদ্ধে তারা ফিরেছে, সতেরো মিনিটের ব্যবধানে তিন তিনটে গোল করে তারা ফিরে এসেছে খেলায়। ছিটকে দিয়েছে ফরাসি দলটিকে। একই টুর্নামেন্টে পরপর তিনবার, তিনটি হেভিওয়েট দলের বিরুদ্ধে এভাবে ফিরে আসা নিয়ে চর্চা হচ্ছে প্রচুর। বিশ্বজুড়ে ফুটবলপাগলদের মধ্যে হইহই ফেলে দিয়েছে লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। (রিয়াল মাদ্রিদ দলটিকে স্পেনে এই নামে ডাকা হয় তাদের সাদা জার্সির কারণে) এই নিয়ে একটা বেশ মজাদার টার্ম বাজারে চলছে, তা হল ‘মনস্টার মেন্টালিটি’। বড়ো ম্যাচে, প্রত্যেকবার ঠিক সময়ে জ্বলে ওঠা মাদ্রিদ খেলয়াড়দের মানসিকতাকে এমন নাম দিয়েছে ইউরোপীয় মিডিয়া। এ প্রসঙ্গে ফিরে যাই বছর সাতেক আগে মাদ্রিদ-আটলেটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে। যেখানে একেবারে অন্তিমলগ্নে গোল করে মাদ্রিদকে খেলায় ফিরিয়ে এনে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন তৎকালীন রিয়ালের অধিনায়ক সের্জিও রামোস। আশ্চর্যজনকভাবে সেদিনও মাদ্রিদের কোচ ছিলেন কার্ল আন্সেলোত্তি, যিনি বর্তমানেও দায়িত্বে আছেন মাদ্রিদ দলটির। সেই ম্যাচে জেতার পর কার্লো আন্সেলোত্তির ফুটবল দর্শন নিয়ে নানা চর্চা হয়েছিল।
স্প্যানিশ মিডিয়ায় ম্যাট উইলজে নামক এক সাংবাদিক পরবর্তীকালে একটি দুরন্ত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মাদ্রিদের সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। সেখানে তিনি বলেন ফুটবল খেলায় চারটি পিলার থাকে। এক, টেকনিকাল, অর্থাৎ একজন খেলোয়াড় ও কোচের ফুটবল বেসিক; দুই, ট্যাকটিকাল অর্থাৎ কোচের ফর্মেশান ও স্টাইল; তিন, ফিজিক্যাল অর্থাৎ খেলোয়াড়দের শারীরিক দক্ষতা এবং চার, সাইকোলজিক্যাল বা মনস্তাত্ত্বিক। এই চতুর্থ পিলারটি নিয়ে চর্চা সবচেয়ে কম, কারণ একটি খেলায় চার পিলারে সমান ভার ন্যস্ত থাকে না। একটি দলের সামগ্রিক শক্তির অনেকখানি নির্ভর করে প্রথম তিনটি পিলারের ওপর, চতুর্থ পিলারের কাজ দুটি সমান টেকনিকাল, ট্যাকটিকাল ও ফিজিক্যাল ক্ষমতা সম্পন্ন দলের মধ্যে তফাৎ গড়ে দেওয়া। ঠিক এই চতুর্থ পিলারের জোর বাড়ানোর অভ্যাস মাদ্রিদ শুরু করেছিল কার্লো আন্সেলোত্তির প্রথম জমানা থেকে। পরবর্তীকালে জিনেদিন জিদান কোচ হয়ে আসার পর এই অভ্যাস তারা ক্রমাগত বাড়িয়েছে। ফুটবল বিজ্ঞান বলছে চতুর্থ পিলারের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা তিন পিলারের ওপর থেকে ভার লাঘব করে একদিন। ঠিক যে তত্ত্বের সুফল রিয়াল মাদ্রিদ পাচ্ছে এই মরশুমে, অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি শক্তিশালী দলকে মানসিক কাঠিন্যে টেক্কা দিচ্ছে তারা বারংবার। এ কোনও ফ্লুক নয়, ঘোরতর বিজ্ঞান। লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুস, করিম বেঞ্জেমাদের মানসিক কাঠিন্য তৈরির প্রসেস আসলে একটি দশ বছরের অভ্যাস। এতিহাদে প্রতিপক্ষ সমর্থকদের চাপ মাথায় নিয়ে পানেনকা ফ্রি-কিক মারতে তাই দ্বিধাগ্রস্ত হন না করিম বেঞ্জেমা।
ফিরে আসি গোড়ার গল্পে। যেখানে আমাদের গ্রাফে বাঁধা জীবনকে দেখে একঘেয়ে লাগছিল। আমরা আসলে একটি ফুটবল খেলার কথা বলছি। কিংবা একটি জীবনের। গ্রাফ কাগজে খোপগুলো ছোটো বড় হচ্ছে কেবল। বাকিটা এক। এক্কেবারে এক। কয়েক মিনিটের মধ্যে সবকিছু এলোমেলো করে ফিরে আসার গল্প আমাকে আরও একটি গল্পের কাছে পৌঁছে দেয়। একটি ম্যাচে সাড়ে ন’হাজার হার্টবিটের মধ্যে হাজার সাতেক হার্টবিটই খরচ হয়ে যাচ্ছে পিছিয়ে থেকে, হারতে হারতে, লড়তে লড়তে, অনিশ্চয়তায়। ফুটবল আমাদের বলছে, কুছ পরোয়া নেহি। সময়ের পরোয়া যারা করে না সময় তাদের পরোয়া করে। একদিন সময় আসবে। আসবেই। বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে আসবে। তখন স্রেফ কয়েকশো হার্টবিট আমরা খরচ করব, আর তাতেই মুহূর্তে পালটে দেব সব। ম্যাট উইলজের চতুর্থ পিলারে আপনি রেখে দিন পরিশ্রম আর মানসিক কাঠিন্যকে। একসঙ্গে বেঁধে দিন। আর জোর বাড়াতে থাকুন এই ফোর্থ পিলারের। ফিনিশিং লাইন টাচ করে উসেইন বোল্ট দু’হাত মেলে দেন, আমাদের ফিনিশিং লাইন এখনও বহুদূর। বহুদূরে নব্বই মিনিটের শেষ বাঁশি।
কিছুদিন আগে খবরে দেখলাম রাজস্থানের হুকুমদাস নামের এক ৭৭ বছরের বৃদ্ধ প্রায় তিরিশবারেরও বেশি চেষ্টা করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছেন, ভর্তি হয়েছেন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে। সারাজীবন আর্থিক অনটন, ভূগর্ভে জলশ্রমিকের প্রবল খাটুনির চাকরি করে বারেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন পরীক্ষায় পাশ করতে। কিন্তু হাল ছাড়েননি। ঐ যে শেষ বাঁশি বাজতে দেরি, অনেক দেরি।
মাদ্রিদ গ্যালারিতে একটা ব্যানার ঝোলে, তাতে লেখা থাকে ‘নাইন্টি মিনিট ইন বার্নাবিউ ইজ অ্যা ভেরি লং টাইম’; এই স্লোগানকে একটু উল্টেপাল্টে নিন জীবনে।
মনে মনে বলুন, ‘থ্রি বিলিয়ান হার্টবিট ইজ আ ভেরি লং টাইম’।
হাল ছেড়ো না বন্ধু। ফোর্থ পিলারে জোর বাড়াও। খেলা ঘুরবে। ঘুরবেই।
Powered by Froala Editor