ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সদ্যোজাত পুত্র সন্তান মারা গেলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে সে-কথা জানালেন স্বয়ং পর্তুগীজ মহাতারকা। প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়ায় টুকটাক লেখালিখির সূত্রে কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ দীর্ঘদিনের। তেমনই এক সুহৃদ টেলিফোনে এ ঘটনার বিষয়ে অবগত করে বললেন - 'কালকের হেডলাইন পেয়ে গেলাম।' রোনাল্ডোর সেই পোস্ট, যেখানে তিনি লিখছেন হতাশার কথা, যন্ত্রণার কথা, সদ্য হারানো শিশুপুত্রের কথা, তা হেডলাইন হতে বাধ্য। বাধ্য কারণ, তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, যাঁর পেশিবহুল শরীরের উদ্দাম উন্মোচন ইঁট গেঁথে দেয় পৌরুষের চিরাচরিত সংজ্ঞায়। আর্বানিটির শর্ত মেনে তিনি গ্ল্যাডিয়েটর৷ তাঁর দু-পায়ের শট কাঁপিয়ে দেবে প্রতিপক্ষের জাল, তিনি আহত হবেন, উঠে দাঁড়াবেন, চাউনিতে নেবেন প্রতিপক্ষকে, অবশেষে জিতে ফিরবেন। এমন চিত্রনাট্য থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটায় তাঁর অসহায়তার কথা। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা তাই প্রকাশ্যে আসতেই তা হয়ে যায় হেডলাইন। এই হেডলাইন হয়ে যাওয়ার কয়েকঘণ্টা পরেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল-ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচ। অ্যানফিল্ডে। রোনাল্ডো স্বাভাবিকভাবেই নেই এই ম্যাচে। ম্যাচের আগেই লিভারপুল সমর্থকদের তরফে জানানো হয় স্টেডিয়ামে রোনাল্ডোর মৃত সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চায় তারা। এরপর, ম্যাচ শুরুর সাত মিনিটের মধ্যে বিশ্ব সাক্ষী থাকে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের।চিরন্তন শত্রুতা ভুলে ম্যাচের সপ্তম মিনিটে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকেন লিভারপুল এবং ম্যান ইউয়ের সমর্থকরা। সদ্যোজাত পুত্রসন্তানকে হারানো রোনাল্ডো এবং জর্জিনা রদ্রিগেজের পাশে দাঁড়াতে মাঠের চারদিক থেকে দেওয়া হয় হাতাতালি। পুরো ৬০ সেকেন্ড ধরে হাতাতালিতে গমগম করতে থাকে অ্যানফিল্ড। শুধু তাই নয়, লিভারপুল সমর্থকরা এক সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে ওঠেন, ‘You'll Never Walk Alone’ (তুমি কখনও একা হাঁটবে না)। যা লিভারপুল সমর্থকদের আত্মপরিচয়ের গান, এ গানের সঙ্গে মিশে আছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৫ সালে অস্কার হ্যামারস্টাইনের লেখা এই গানটি এক অন্য মাত্রা পায় ১৯৮৯ সালের হিলসবরো ডিজাস্টারের পর। শেফিল্ডের মাঠে সেদিন প্রবল বিশৃঙ্খলায় চলে গিয়েছিল ছিয়ানব্বইটি তরতাজা প্রাণ। যদিও তারও আগে ১৯৮৫ সালে ব্র্যাডফোর্ড সিটিতে প্যারেডের সময় গুলি, এবং ২৫ জনের মৃত্যুর সময় এ-গানের লিরিক ও সুরে বদল আসে, পরিমার্জিত হয় এই গান। তারপর থেকে দীর্ঘ তিরিশ বছর এই গান বিটলসের শহরে, লিভারপুলের আনফিল্ড স্টেডিয়ামে চিৎকার করে গান হাজারে হাজারে সমর্থক, পাশে বসা অচেনা মানুষকে জড়িয়ে ধরেন তাঁরা। নিজের দলের খেলোয়াড়দের সমর্থনে এ দৃশ্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মহাতারকার জীবন, ব্যক্তিজীবনের পরিসরে এভাবে প্রতিপক্ষের হানা প্রথমবার। হানা শব্দটি নিয়ে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করবেন না, হে পাঠক। এ হানায় কোনো প্রতিশোধ নেই, হিংসা নেই, কোনো স্কোরলাইন মিলিয়ে দেওয়ার রোমাঞ্চ নেই, আছে শুধু সহমর্মিতার সোপান। ভালবাসাও তো একধরণের হানা। ব্রিটিশ মুলুকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুলের লড়াই-এর সুদীর্ঘ ইতিহাস কারও অজানা নয়। স্টেডিয়াম পেরিয়ে সে চিরকালীন দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে দুই কুলীন ক্লাবের অগণিত সমর্থকের জীবনে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল সদ্য পড়া একটি বই-এর কথা। জয়দীপ ঘোষের লেখা বইটির নাম 'তারই কিছু রং'। সেখানে তিনি লিখছেন এই বিশ্বের সর্বশেষ কুয়াই-ও-ও পাখিটির কথা। সেই পুরুষ 'কুয়াই ও-ও' পাখির ডাকটি ইউটিউবে পাওয়া যায়। এটি রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, মার্কিন মুলুকের জমকালো শহর নিউ ইয়র্কের কর্নেল ল্যাব অফ অর্নিথোলজিতে। আর এই ডাক ছিল তাঁর সঙ্গিনীকে আহ্বানধ্বনি। কিন্তু, হায়, এই ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো আর একটি পাখিও এ বিশ্বে আর উপস্থিত ছিল না সেদিন। এত রিক্ত, নিঃস্ব চিৎকারের কাছে আমাদের নতজানু হতে হবে। এই ডাক রেকর্ডের কয়েক মাসের মধ্যেই পাখিটি মারা যায়, এবং পৃথিবী থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে যায় কুয়াই-ও-ও পাখি। প্রকৃতির নিয়ম মেনে মানুষ নামক প্রজাতিটিকেও তো একদিন বিলুপ্ত হতে হবে এ মায়াবিস্তারের কোল থেকে। হয়ত, আমার, আপনার কোনও একজন উত্তরসূরি সেদিন বেঁচে থাকবে, ডাকবে আমাদের, অথচ, সেই ভাষা বোঝার মতো কেউ আর থাকবে না। কুয়াই-ও-ও পাখি, ঘানাইয়ান রেড কলোবাস, আফ্রিকান কোয়াবা-র মতো কয়েকশো প্রাণী গত দুটি শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ পৃথিবী থেকে। এই শতকে এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। অন্তত পরিবেশবিজ্ঞান তাই বলছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভের একটি ওয়েবসাইট ঘাঁটতে গিয়ে বারেবারে মনে হচ্ছিল, এই বিশ্বের বিপুল জীববৈচিত্রের মাঝে ক্ষুদ্র মানব একাকী ভ্রমণের বিস্ময় যেদিন হারিয়ে ফেলল, সেদিন থেকেই বোধকরি স্বপ্রজাতি দ্বন্দ্বের শুরু, হিংসার শুরু। বিগ ব্যাং থেকে পৃথিবী সৃষ্টির পর ১৩৮০ কোটি বছরের ও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, আরও প্রায় ৭০০ কোটি বছর পরে পৃথিবী মিশে যাবে সূর্যের গহ্বরে। অর্থাৎ, যে অসীম গর্ভ থেকে তার জন্ম, সে ফিরে যাবে সেই আদিম অগ্নি গহ্বরেই। এই প্রায় বাইশশো কোটি বছরের ও বেশি সময়ের রঙ্গমঞ্চে মানুষ একটি জীব। কয়েক কোটি প্রজাতির মতোই সামান্য জীব। তাঁর আগমন থেকে বিলুপ্তির টাইমফ্রেম এই বিরাট মঞ্চের কত শতাংশ হতে পারে? ধূলিকণার চেয়েও কত ক্ষুদ্র হতে পারে সেই সংখ্যা? এসব ভাবলে দ্বন্দ্ব চলে যায়। মনে পড়ে দেওয়ালে এসে স্থির হতে যাওয়া ক্লান্ত কাঠবিড়ালির কথা। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে এ-লেখার গোড়ায় সেই বন্ধুর 'হেডলাইন'-এ। রোনাল্ডোর ব্যক্তিগত শোকের হেডলাইনের পাশে কি জায়গা পাবে অ্যানফিল্ডের এই গান? অসীম কালপ্রবাহে একটি ছোট্ট সময়খণ্ড ঐ ৬০ সেকেন্ড। যেখানে প্রতিপক্ষ কেবল মহাকাল, নিয়তি। আর কেউ নয়। সবাই আদতে বন্ধুই। বিগত শতক দেখেছে দু'দুটো বিশ্বযুদ্ধ। এই দশক দেখল শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো মহামারী। আমাদের পাশ থেকে সরে গেছে কত কত চেনামুখ। ফিরি অস্কার হ্যামারস্টাইনের গানের কথায়-
'When you walk through a storm
Hold your head up high
And don't be afraid of the dark...
Walk on, walk on
With hope in your heart
And you'll never walk alone
You'll never walk alone...'
একা হাঁটবে না। কেউ একা হাঁটবে না। তেইশশো কোটি বছরের ভেতর যে ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এ মহাকাল বরাদ্দ করেছে আমাদের জন্য, সেখানে আমরা সহযাত্রী। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, আপনি একা নন, আমাদের ব্যথার রং এক। আমাদের আনন্দের রং এক। 'আমাদের মনে রং, মিলে যাক দুনিয়ার...'
Powered by Froala Editor