গত বছর আমার এক সহকর্মী কাজের সূত্রে কানাডায় শিফট করলেন। সে-দেশের নিয়মানুসারে দীর্ঘদিন থাকার জন্য নাগরিকত্বের যে নিয়ম, তা মেনে পাকাপাকিভাবেই আপাতত সে কানাডার অধিবাসী। এই দেশ থেকে চাকরির প্রয়োজনে কানাডা পাড়ি দেওয়া মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেই সহকর্মীর কাছেই শুনছিলাম অন্টোরিয়ো, টরন্টো থেকে সামান্য দূরে, জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে গেলেই একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করা যায়। আফ্রিকান, সোমালিয়ান, ভারতীয়, চাইনিজ,রাশিয়ান জনগোষ্ঠীরা নিজেদের মতো মহল্লা গড়ে তুলেছেন। এঁরা প্রত্যেকেই কানাডার নাগরিক। এমনকি টরন্টো শহরে ভারতীয়, চাইনিজ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, মঙ্গোলিয়ান, নাইজিরিয়ান খাবারের দোকান, জামাকাপড়ের দোকানেও একটা অদ্ভুত সহাবস্থান৷ চট করে কাউকে না জানিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিলে সে বুঝে উঠবে না, কোন দেশে আছে। ভাষার বৈচিত্র-র কথা বাদই দিলাম। অথচ, দেশটির নাম কানাডা। আমার সেই সহকর্মীর সঙ্গে কথা হত ভিডিও কলে, মাঝেমধ্যে, ওঁর কথা মনে পড়ছিল খুব। গত সপ্তাহে কানাডার জাতীয় ফুটবল দল(কানাডা ও মার্কিন মুলুকে ফুটবলকে সকার বলার চল খুব, যদিও সকার-ফুটবল বিতর্ক নতুন না) ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল। খবরটা এটুকুতে শেষ হলে একটা উত্থানের গল্পেই আটকে রাখা যেত বিষয়টিকে, কিন্তু, এর চেয়েও জরুরি হেডলাইন হল কানাডার এই জাতীয় দলের এগারোজন ফুটবলারের মধ্যে নয়জনই আসলে কানাডায় অভিবাসী। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা রিফিউজি, যাঁদের আশ্রয় দিয়েছে কানাডা। আলফানসো ডেভিস-এর নাম এখন সুপরিচিত। মার্কিন মুলুকে ফুটবলের সবচেয়ে বড়ো তারকা এখন বায়ার্ন মিউনিখের এই সাইডব্যাক। গতবছর ডেভিস নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গেই উঠে এসেছিল কানাডায় অভিবাসী ফুটবলারদের নিয়ে না না তথ্য৷ তখনও ভাবিনি, এমন একটা রূপকথার গল্প অপেক্ষা করে আছে।
কানাডার এই দলটির গোলকিপার মিলান বোর্হান প্রসঙ্গে পড়ছিলাম। নয়ের দশকের গোড়ায় ক্রোয়েশিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন মিলান বোর্হানের বাবা-মা। মিলানের বয়স তখন তেরো। একটি সাক্ষাৎকারে মিলান বলছেন— 'আমার সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগে। আমাদের কিচ্ছু ছিল না, এই দেশে আসার পর এই দেশ আমাদের আপন করেছে। ফুটবল খেলতে পেরেছি, এ স্বপ্ন মনে হয় যেন...'। ফরোয়ার্ড ইকে উগবো চেলসিতে খেলার সুবাদে ইউরোপিয়ান ফুটবল সার্কিটে কিঞ্চিৎ পরিচিত নাম। আদতে নাইজিরিয়ান অরিজিন, কানাডায় অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন পনেরো বছর আগে। এখন জাতীয় দলের তারকা। জোনাথান ডেভিড সুদূর হাইতি থেকে মাত্র ছ'বছর বয়সে এসেছিলেন কানাডায়। মিডফিল্ডার ইসমাইল কোনে এসেছেন আইভরি কোস্ট থেকে। রাইট উইং রিচি ল্যারেয়া জন্মেছিলেন ঘানার বাডাবুড়ামের একটি রিফউজি ক্যাম্পে, ১৯৯৯ সালে লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ে প্রাণভয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন কানাডায়। অনিশ্চয়তা থেকে নিশ্চিত জীবনের দিকে এগিয়ে দেয় যে সিঁড়ি, তাকেই কি দেশ বলে? এই অভিবাসী ফুটবলারদের সাক্ষাৎকারের কিছু টুকটাক ইউটিউবে সহজেই খুঁজলে পাওয়া যায়। শুনে দেখতে পারেন। কেউ চাইলেই। কানাডায় তাঁদের এসে পড়া ও অদ্ভুতভাবে কানাডার 'নাগরিক' হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে কিছু জরুরি বক্তব্য পেয়ে যাবেন। আর আমাদের সামনে খুলে যাবে এক বিশাল দরজা। গত একদশকে রিফিউজি সমস্যা বিশ্বব্যাপী যে প্রবল হারে বেড়েছে, তা নিয়ে নিত্য আলোচনা হয়। রিফিউজি সমস্যা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করার জন্য এ বিষয়ের অবতারণা নয়। বরং কানাডার এই অভিবাসী মডেলটির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবগত হতে পারি।
১৯৭০ সালে কানাডার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকাকালীন পিয়ের ট্রুডো কানাডায় অভিবাসী আগমন নিয়ে একটি মতামত রাখেন। সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবে জানান—
'Canada will officially adopted a policy to promote multiculturalism, and ever since it’s been a key part of the Canadian identity.'— অর্থাৎ কানাডার জাতিগত পরিচয়ের শিকড়ই হবে মাল্টিকালচারালিজম বা সাংস্কৃতিক সমন্বয়। আমাদের ভেবে দেখা আশু প্রয়োজন কানাডার ঠিক গা ঘেঁষে থাকা আমেরিকা রাষ্ট্রে যখন বারেবারে সরকার বদল হয়েছে, বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব প্রকট হয়েছে, হালফিলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিফিউজি ও অনুপ্রবেশকারী বিদ্বেষী মনোভাব নতুন নয়। বছর দুই আগে সি এম এস (সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিস)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ট্রাম্পের তিনদফা এক্সিকিউটিভ অর্ডারে উনি শুধু মার্কিনি বলে নয়, সারাবিশ্বেই উদ্বাস্তু, রিফিউজি, অনুপ্রবেশকারীদের মানবাধিকার লঘু করার পরোক্ষ হুমকিও দিয়েছেন তিনি। আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের সঙ্গে ভিসা সমস্যা ও গ্রিনকার্ড ইস্যু নিয়ে কথা বললেই এ বিষয়ে অনেক জরুরি তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু, কানাডা সত্তর সালে নেওয়া অনুপ্রবেশকারী নীতি এবং উদ্বাস্তু আশ্রয়ের বিষয়টিকে হাজার মার্কিনি চোখরাঙানির পরেও একইভাবে ধরে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো শুধু মানবাধিকারই নয়, এই মুহূর্তে কানাডায় নিয়ে এসেছেন মোজাইক মডেল। মোজাইক মডেল কী? মোজাইক মডেল হল অনুপ্রবেশকারীদের বিভিন্ন সংস্কৃতিকে একই সুতোয় গেঁথে একটি মোজাইকের ন্যায় স্বতন্ত্র কানাডিয়ান সংস্কৃতি গড়ে তোলা। যেমন ২০১৮ সালে কানাডা প্রায় সাড়ে তিনলক্ষ অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছিল। দিয়েছিল নাগরিকের সকল সুযোগ সুবিধা। তার মধ্যে ৫৭% চাকুরীজীবি, প্রায় সাড়ে বাইশ শতাংশ উদ্বাস্তু এবং মাইনরিটি। সংস্কৃতির সমন্বয় তাই সময়ের দাবি মেনেই এসেছে।
ফিরে আসি ফুটবল প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া ফরাসি ফুটবল দলটিতেও এমন ঘটনা দেখা গিয়েছিল। করিম বেঞ্জেমা, এনগোলো কান্তে সহ বহু বিশ্বজয়ের নায়কই ফরাসি অভিবাসী। আদতে কেউ আলজিরিয়ান, কেউ বা নাইজিরিয়ান বা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জিন বহন করছেন শরীরে। কোয়ার্জের সমীক্ষা অনুসারে এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।
ফুটবল বিশ্বকাপের থিমসং হিসেবে ২০১০ সালে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সোমালিয়ান রিফিউজি কে'নানের গাওয়া সেই বিখ্যাত 'ওয়েভিন ফ্ল্যাগ' গানটি।
'Give me freedom, give me fire, give me reason, take me higher...'
গানটিকে কেবল বিশ্বকাপের থিমসং করেই থেমে থাকতে চায়নি ফিফা। ফুটবল, দ্যা গ্লোবাল গেমের আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বব্যাপী মুক্তির পথ দেখানো পায়ে পায়ে গড়ানো বলখানার গায়ে যেন ডানা লাগিয়ে দেয় এই গান।
' They'll call me freedom, just like a wavin flag...'— উড়তে থাকা পতাকা। কোন দেশের? জানে না কেউ। আসলে মুক্তিনিশানে কোনও মানচিত্র থাকে না কোনোদিন। আলফানসো ডেভিস যখন উইং থেকে দৌড় শুরু করবেন কাতারে তখন তিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন একটি দেশের৷ যে দেশ তাঁর আশ্রয়। জনাথান ডেভিন, মিলান বোর্হানরা প্রতিনিধিত্ব করবেন মাটির। ভাষার। ছায়ার। হয়ত একটি দেশেরও, যে দেশ তাঁদের আশ্রয় দিয়েছে, ফুটবল কিন্তু এখানে পেরিয়ে যাবে দেশের সীমানা, পৌঁছে যাবে একটি সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, হানাহানির শেষে একফালি ছায়া, যেখানে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা...
Powered by Froala Editor