“কিতনে ইনাম রাখে হ্যায় সরকার হাম পার?”
‘শোলে’ সিনেমা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই কালজয়ী সংলাপের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। গব্বর সিং (Gabbar Singh)। ‘শোলে’ সিনেমায় আমজান খান অভিনীত এই চরিত্রটির শীতল হাসি হাড় কাঁপিয়ে দিতে বাধ্য যে-কারোর। কিন্তু সবটাই পরিচালকের কি কল্পনা আর সিনেম্যাটিক প্রেক্ষাপট?
হ্যাঁ, ১৯৭৫ সালের হিন্দি সিনেমার এই কিংবদন্তি ভিলেন চরিত্রটিকে আদতে নির্মাণ করা হয়েছিল এক বাস্তব ডাকাতের অনুপ্রেরণাতেই। এমনকি চরিত্রের নামটুকুও অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহৃত হয় সিনেমায়। আজও যার নাম আতঙ্কের সৃষ্টি করে মধ্যপ্রদেশের হাজার হাজার মানুষের মনে। অবশ্য ‘ডাকাত’ বললে ভুল হবে। বাস্তবের গব্বর নিজের পরিচয় দিত ‘বাগী’ হিসাবে।
‘বাগী’ কথাটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চম্বল উপত্যকা। রুক্ষশুষ্ক বালিয়াড়ির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা সরু নদী আর উঁচু উঁচু ঢিবি। ১৯২৬ সালে বাস্তবের গব্বর— গব্বর সিং গুজ্জরের জন্ম এই বেহড় অঞ্চলেই। ভিণ্ড শহরের ছিনশটেরা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। বাবা-মা সামান্য দিন-মজুরের কাজ করতেন। কৃষিজমি ছিল যৎসামান্য। কিন্তু সেই রুক্ষ জমিতেই বা কতটুকু ফসল জন্মায়। ফলে, কৈশোর থেকে গব্বরকেও হাঁটতে হয়েছিল সেই পথেই। পাথার ভাঙা আর সেই পাথর পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ।
প্রাত্যহিক এই অনুশীলনে কৈশোর থেকেই যথেষ্ট শক্তসমর্থ ছিল গব্বর। শারীরিক শক্তির জন্য ধীরে ধীরে বেড়েছিল অহংকারও। কখনও কখনও গ্রামের মানুষদের সঙ্গে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়ত সে। তবে তার হিংস্র হয়ে ওঠা আরও পরে। চল্লিশের দশকের শেষের দিক সেটা। সামান্য অপরাধের জন্য, তার বাবার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল শেষ সম্বল জমিটুকুও। এমনকি একঘরে করে দানা-পানিও বন্ধ করে দিয়েছিল সমাজ। এই ঘটনার পর থেকেই ক্রমে রক্তে হাত ধুতে শুরু করে গব্বর। তার হাতে প্রথম খুন হয় রখীশ্বর নামের এক ব্যক্তি। যার সঙ্গে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত শত্রুতা তৈরি হয়েছিল গুজ্জর পরিবারের।
ব্যাপারটা পুলিশের কাছে পৌঁছাতে, গব্বর যোগ দেয় চম্বলের বিখ্যাত ডাকাত কল্যাণ সিং গুজ্জরের দলে। শারীরিক সক্ষমতা তো ছিলই, পাশাপাশি খুন করার সাহসিকতা দেখানোর জন্য ডাকাত দলে জায়গা পেতে অসুবিধা হয়নি গব্বরের। সেই শুরু। এরপর ক্রমশ চম্বলজুড়ে বাড়তে থাকে গব্বরের প্রতাপ। কল্যাণ সিং–এর অবর্তমানে গব্বরই হয়ে ওঠে বেহড়ের রাজা। বাড়াতে থাকে তার দলও।
মজার বিষয় হল, শুধু গব্বর চরিত্রটিকেই নয়, তার বর্বরতা এবং নৃশংসতাকে সামনে রেখেই সিনেমায় রাখা হয়েছিল ‘ঠাকুর’-এর হাত কেটে নেওয়ার দৃশ্যটি। অবশ্য আমাদের গল্পের ‘ভিলেন’ গব্বর সিং গুজ্জর কারোর হাত কাটেনি বাস্তবে। বরং, তার শাস্তি দেওয়ার কৌশল ছিল আরও খতরনাক। জীবিত মানুষকে বন্দুকের বাট দিয়ে এলোপাথাড়ি মারধর করে, ছুরিয়ে দিয়ে নাক কেটে নিত বাস্তবের গব্বর সিং। কখনও আবার কেটে নিত কানের পাতা।
গব্বরের এই পাগলামি আরও বেড়ে গিয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষে। নেপথ্যে এক তান্ত্রিক। দেবী উপাসক গব্বরকে এক তান্ত্রিক পরামর্শ দিয়েছিলেন ১১৬ জন মানুষের নাক কেটে দেবীকে অর্ঘ্য দিলে নাকি পুলিশের গুলি ছুঁতে পারবে না তাকে। তাতে আরও বেড়ে যায় তার পাগলামি। পুলিশের ডায়েরির পরিসংখ্যান বলছে সবমিলিয়ে প্রায় ১৬০ জনেরও বেশি মানুষের নাক কেটেছে গব্বর। হত্যা করেছে শতাধিক মানুষকে। তবে গ্রামের লোককথা অনুযায়ী, গব্বরের হাতে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা হাজারের কম নয় মোটেই। সেই তালিকায় রয়েছে বহু পুলিশকর্মীও। সেইসঙ্গে যেখানেই পা পড়ত গব্বরের, লুঠতরাজ চলতই।
শুধু সাধারণ মানুষই নয়, গব্বরের এই তাণ্ডবে কাটা পড়েছিল সরকারের নাকও। গব্বরের শিকার হওয়া এ-হেন বহু মানুষকে কাঠ বা প্লাস্টিকের তৈরি নকল নাক দিতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসন। পাশাপাশি এও রেকর্ড আছে, যে-গব্বরের তাণ্ডবে পুলিশ প্রশাসনের অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রীতিমতো বিধানসভার বাইরে অবস্থান নিয়েছিল ভিণ্ডের মানুষজন। তবে তারপরও তাকে বধ করতে লেগে যায় আরও কয়েক বছর। গব্বর সিং-এর এই নৃশংসতার শেষ হয় ১৯৫৯ সালে।
দিনটা ছিল ১৩ নভেম্বর। গ্রামের এক যুবকের পরিবার শিকার হয়েছিল গব্বরের। সে-ই গব্বরের গোপন ডেরার খবর পৌঁছে দিয়েছিল পুলিশের ডিএসপি আরপি মোদির কাছে। সেই মাফিক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আক্রমণের নীল-নকশা। পরদিন রাতে প্রায় ৩০০ জনের পুলিশ বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল গব্বরের ডেরাকে। তারপর শুরু হয়েছিল গুলির লড়াই। সেই এনকাউন্টারেই মৃত্যু হয় গব্বর সিং-এর। গ্রেনেডের বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল চোয়াল। ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জবাহরলাল নেহরুর জন্মদিনে উপহার হিসাবেই এই ‘সুসংবাদ’ প্রদান করেছিলেন ডিএসপি আরপি মোদি।
তারপর কেটে গেছে প্রায় ছ’দশক। তবে আজও গব্বরের আতঙ্ক ছেয়ে রয়েছে ভিণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। আজও কাঠ বা প্লাস্টিকের নকল নাক নিয়ে জীবিত রয়েছেন বহু মানুষ। তাঁরাই চম্বলের ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায়ের জীবন্ত প্রমাণ…
তথ্যসূত্র :
১. गब्बर ने तांत्रिक के कहने पर 116 लोगों के नाक-कान काटकर देवी को चढ़ा दिए थे, Dainik Bhaskar
২. Gabbar Singh Gujjar, Wikipedia
৩. দুর্ধর্ষ দুশমন (ধারাবাহিক), শুভেন্দু দেবনাথ, Prohor.in
Powered by Froala Editor