অন্যান্যদের মতো স্কুলে যেতেন তিনি। বেশ ভালোই লাগত। কিন্তু বেশ কিছু জিনিস বুঝতে পারতেন না তখন। ক্লাসরুমে শিক্ষক ঢোকার পর স্পষ্ট করে বলে দিতেন অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে যেন তিনি না বসেন। বাকি বন্ধুরাও পারলে তাঁর ছায়া বাঁচিয়ে চলে। কেন ওঁরা এমন করে? রাতে শোয়ার আগে এমন প্রশ্নই মাথায় আসত। এখনও মাঝে মাঝে এমন কথা ভাবেন ডঃ পিকে মহানন্দিয়া। তাঁর যাত্রা শিখর ছোঁয়ার গল্প। একটা সময় বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কারণ, তিনি দলিত। তিনি নাকি ‘অচ্ছুত’। আর আজ দুটো দেশের নাগরিকত্ব; সেইসঙ্গে সুইডেন সরকারের আর্ট অ্যাডভাইসর। তাঁর শিল্পের সমঝদার সমস্ত জায়গায়।
সামান্য এক তাঁতির পরিবারে জন্ম মহানন্দিয়ার। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা, যেভাবে পাপড়ি এক সময় ফুলের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারতের মতো দেশে আজও অনেক সমস্যা দানা বেঁধে রয়েছে। দলিত হওয়ার জন্য কম অপমান সহ্য করতে হয় না আমাদের দেশের একটা অংশের নাগরিককে। সহ্য করতে হয়েছে মহানন্দিয়াকেও। স্কুলের কথা তো বলা হলই। দলিত হওয়ার জন্য স্কলারশিপের টাকা আসত না। এমনকি চাকরিও হত না! কেন? তুমি দলিত!
কিন্তু একটা জিনিসই ছিল যা দিনের শেষে তাঁকে শান্তি দিত। শিল্প, আঁকা। পেনসিল, ক্যানভাস আর রং-তুলি পেলেই তিনি নিজের সামনে অন্য এক দুনিয়া খুঁজে পেতেন। তখন এইসব প্রতিবন্ধকতাকে আর কিছুই মনে হত না। পেয়েছিলেন বিশ্বভারতীর শিক্ষা, যা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আজও। জীবন একদিন সুযোগ নিয়ে এল। বিশ্বের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা ভারতে এলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে একটা স্কেচ উপহার দিলেন পিকে মহানন্দিয়া। আর এই ঘটনাই তাঁর জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দিল। খবরের কাগজে প্রথমবার জায়গা পেল তাঁর নাম। মহানন্দিয়া হয়ে গেলেন ‘জাঙ্গল ম্যান’। এরপর ইন্দিরা গান্ধীরও স্কেচ আঁকলেন তিনি। এই করেই এগিয়ে চলল তাঁর রথ।
ইতিমধ্যেই জীবনে চলে এলেন আরও একজন। নাম শার্লট ভন শেভিন। তিনিও সুইডেন থেকে ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন। পিকে মহানন্দিয়ার কাছে একটি ছবিও আঁকিয়েছিলেন। আর সেটাই দুজনকে কাছে টেনে আনল। শার্লট সুইডেনের অভিজাত পরিবারের একজন, এদিকে মহানন্দিয়া দলিত। তাতে কী হয়েছে? সমস্ত কিছু বিক্রি করে, সেকেন্ড হ্যান্ড একটা বাই সাইকেল নিয়ে সুইডেন চলে গেলেন তিনি। ব্যস, তারপর সেখানেই বাকি গল্প…
আরও পড়ুন
সারাজীবন লড়েছেন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে, ক্যানসার কেড়ে নিল জন লুইসের প্রাণ
আজ শুধু সুইডেন নয়, ভারতেরও একটি বড়ো নাম ডঃ পিকে মহানন্দিয়া। ইউনিসেফের হয়ে অনেক কাজ করেছেন; সেই সঙ্গে সুইডেন প্রশাসনের সঙ্গেও যুক্ত। বিশ্বের নানা জায়গায় তাঁর আঁকার প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু আজও কি ভুলতে পেরেছেন পুরনো দিনগুলোর কথা? আরও কত পিকে মহানন্দিয়ারা লড়াই করছে ময়দানে। তাঁরা কি উঠে আসতে পারছেন? এই ইদুর দৌড়ের বাজারে যেখানে প্রতি মুহূর্তে পিষে ফেলার খেলা চলছে; সেখানে ‘দলিত’ হওয়াও তো অপরাধের চোখেই দেখছেন অনেকে। তাঁদের কী হবে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সব রঙ-ই সুন্দর, একসঙ্গে আঁকতে আঁকতেই বর্ণবৈষম্যর বিরুদ্ধে পাঠ নিচ্ছে আমেরিকার শিশুরা