ফুটপাতের জীবন থেকে আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফার – পুরুলিয়ার ছেলের আশ্চর্য উড়ান

ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ সিনেমাটির কথা মনে পড়ে? সেই যে একটা ছেলে বাড়ি-ঘর ছেড়ে শহরে চলে এসেছিল। এই গল্পটিও এক বাড়ি পালানো ছেলের গল্প। অবশ্য এটিকে ঠিক গল্প বলা যায় না, বরং ঘুরে দাঁড়ানোর সত্যি ঘটনা হিসেবে দেখা যায়। এই গল্প ভিকি রায়ের।

আরও পড়ুন
এখনও ক্যামেরা ছাড়েননি বীরভূমের প্রথম প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার

ভিকি-র যখন তিন বছর বয়স, তখন তাঁর মা–বাবা তাঁকে ছেড়ে চলে যান। দাদুর কাছে অন্যান্য ভাইবোনদের সঙ্গে বড় হতে থাকেন তিনি। কিন্তু, সমস্তকিছু সেখানে স্বাভাবিক ছিল না। প্রায় প্রতিদিনই দাদুর অত্যাচার সহ্য করতে হত। এমনকি, বাইরের কারও সঙ্গে খেলতে দেওয়া হত না তাঁকে। একটা সময় সহ্যের বাঁধ ভাঙে। এগারো বছর বয়সে, ন’শো টাকা চুরি করে পুরুলিয়া থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ছোট্ট ভিকি। নিছক শহর দেখার জন্য নয়, বরং ভালভাবে বাঁচার জন্য। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। দিল্লির অচেনা গলিতে, একা একটা এগারো বছরের ছেলের দিন কীভাবে কাটতে পারে, সে ব্যাপারে খানিকটা আন্দাজ করতে পারি আমরা। স্টেশনে জলের বোতল বিক্রি করে, হোটেলে-ধাবায় বয় হিসেবে, ময়লা পরিষ্কার করে দিন গুজরান হয় ভিকির। রাস্তায় ফেলে দেওয়া খাবারই সম্বল তাঁর, কোনোদিন সেটাও জোটে না।

কথায় বলে, খারাপ সময় কখনও চিরস্থায়ী হয় না। একদিন না একদিন সূর্য ঠিকই উঁকি দেয় মেঘের আড়াল থেকে। দিল্লির ফুটপাতে অভাবে, রোগে যখন জীবন কাটছে ভিকির, সেই সময় সালাম বালাক ট্রাস্ট নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নজর পড়ে তাঁর ওপর। সেই দিন থেকেই দিল্লির ফুটপাত জীবনের ইতি। এরপর, সেই সংস্থার তরফ থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন ভিকি। এই সময়ই তাঁর পরিচয় হয় ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার দিক্সি বেঞ্জামিনের সঙ্গে, যিনি সালাম বালাক ট্রাস্টের ওপর একটি ফিচার শ্যুট করতে এসেছিলেন। ভিকির জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল অ্যাপারচার, ফোকাস, লাইট ইত্যাদি শব্দগুলি। হাতে উঠে এল ক্যামেরা। এখান থেকেই শুরু হল সাধারণের যাত্রা, অসাধারণের দিকে।

এরপরের গল্পটা হল স্বপ্ন সত্যির। ২০০৭ সালে দিল্লিতেই ভিকি রায়ের প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর নাম ‘স্ট্রিট ড্রিমস’। দীর্ঘকাল ফুটপাতে থাকার ফলে সেখানকার জীবন এবং চরিত্রদের একদম কাছ থেকে নিজের মতো করে দেখেছিলেন ভিকি। সেইসবই উঠে আসে তাঁর ক্যামেরায়। সেই প্রদর্শনীই তাঁকে আজকের সেলিব্রিটি ফটোগ্রাফার হিসেবে মঞ্চে নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে তাঁর তোলা ছবি ছড়িয়ে পড়ে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, সান ফ্রান্সিসকো-সহ আরও নানা জায়গায়। পরবর্তীকালে ফোর্বস ম্যাগাজিনেও তাঁর নাম উঠে আসে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি।

দাদুর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটা সময় বাড়ি ছেড়েছিলেন ভিকি। ফুটপাতের অত্যন্ত কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও সেই বাঁচার ইচ্ছাটা তাঁর কখনও যায়নি। আজ যখন সারা পৃথিবীর কাছে তিনি একটি পরিচিত নাম, তখনও তিনি স্বপ্ন দেখেন পুরুলিয়ায়, তাঁর বাড়িকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তোলার। যে ছোট্ট ছেলেটার চোখ একদিন বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল, আজ সেই চোখই নতুন নতুন ছবির জন্ম দিচ্ছে।

ছবি ঋণ - vickyroy.in

Latest News See More