১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাস, উত্তর কলকাতার আহিরীটোলা স্ট্রীটে ৫১ নম্বর বাড়িটিতে সেদিন ভারী আনন্দের লহর। বাড়ির কর্তা কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের মনটা ভীষণ খুশি, তাঁর বড় মেয়ে চপলার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। অবশেষে বাবাঠাকুর এ গৃহে এসেছেন। চপলা দেবী তখন ছাদে বসে তাঁর তিন মাসের শিশুপুত্রটিকে রোদে তেল মাখাচ্ছিলেন। হঠাৎ দীর্ঘ ছায়া দেখে খেয়াল করলেন বাবাঠাকুর শ্রী পূর্ণ সন্ন্যাসী ছাদে এসেছেন! আকস্মিকতায় তাড়াতাড়ি তাঁকে আভূমি প্রণাম করলেন চপলা দেবী। সন্ন্যাসী স্মিত হেসে আশীর্বাদ করে বললেন " কই মা, তোর সন্তান কোথায়?" চপলা বুঝলেন তাঁর পিতা বাবাঠাকুরকে ইতিমধ্যেই তার মনোবাসনা জানিয়েছেন। বাবাঠাকুর এগিয়ে গেলেন, ছাদের উপর শুয়ে রয়েছে গৌর বর্ণ, হৃষ্টপুষ্ট এক শিশু। নবজাতকের মাথায় হাত রেখে সন্ন্যাসী বললেন "বাহ্ এ তো উত্তম ছেলে! এর নাম রাখ উত্তম।"
এ-কথা শুনে চপলা দেবী ঈষৎ বিমর্ষ হয়ে গেলেন, নামটি তাঁর পছন্দ হয়নি। তাঁর প্রথম সন্তান ছিল কন্যা, তাকে দেখে পুতুল নাম দিয়েছিলেন বাবাঠাকুর ,সেই নামই দেওয়া হয়। কিন্তু এবার চপলা বলেই ফেললেন বাবাঠাকুর এই 'উত্তম' নামটা কেমন ওড়িয়া ধরণের, বাঙালি ঘরের ছেলের এই নাম?" এতটুকুও বিরক্ত না হয়ে সন্ন্যাসী বললেন "আচ্ছা বেশ, তোর যদি এতই অনিচ্ছা হয় তুই অন্য কোনো ভাল নাম রাখিস, তবে ডাক নাম যেন উত্তম হয়। দেখবি ভবিষ্যতে এই নাম ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে।" এদিকে অচেনা মানুষের হাতের স্পর্শ পেয়ে শিশুর কাঁচা ঘুম গেল ভেঙে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার চোখ মেলে অচেনা মানুষ দেখেও সে একটুও কাঁদল না। বরং ঈষৎ ঘুমজড়ানো চোখে চেয়ে সে এক অদ্ভুত হাসি উপহার দিল। শিশুর দিকে চেয়ে বাবাঠাকুর তার মাকে বললেন "হাসিটা দেখেছিস! এই হাসি গোলমাল করে দেবে অনেকের।"
সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। সেইদিনের সেই ছোট শিশু পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ মহানায়ক উত্তমকুমার! জীবিত থাকলে যাঁর আজ বয়স হত ৯৫। অথচ তাঁর বয়স আজও সেই ৫৪-তেই আটকে রয়েছে! মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরেও আজো বড়োপর্দায় তাঁর রাজপাট অটুট! ভুবন ভোলানো হাসিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ভাবতে অবাক লাগে ঠিক কী কারণে আজও সমান প্রাসঙ্গিক উত্তমকুমার? শুধুই কী তিনি রোমান্টিক নায়ক বা সুদক্ষ চরিত্রাভিনেতা ছিলেন বলে? নাকি নিজের স্টারসুলভ ইমেজকে আমৃত্যু সযত্নে আগলে রেখেছিলেন বলে তাঁর এই প্রতিপত্তি? এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর ঠিক একমুখী নয়। কার্যকারণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস্তব, রটনা, মিথ্যে, মিথ সব একাকার হয়ে গিয়েছে নায়ক জীবনের উজ্জ্বল আলোকরেখায়। ঠিক সেই কারণেই আমরা পিছিয়ে যাব সেই শুরুর দিনগুলিতে, যখন উত্তম ওরফে অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় নিজের প্রকাশ মাধ্যম রূপে খুঁজে পেলেন অভিনয়কে! অভিনয় শিল্পের প্রতি তার এই আকর্ষণ কিন্তু একেবারেই আনকোরা ব্যাপার ছিল না। উত্তমকুমারের পিতা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাইয়েরা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক। ভবানীপুরে গিরীশ মুখার্জি রোডের বাসভবনেই তারা গড়ে তুলেছিলেন যাত্রা দল 'সুহৃদ সমাজ'। বাড়িতে নিয়মিত মহড়া এবং পাড়ায় প্যান্ডেল বেঁধে অভিনয় করতেন তাঁরা।
বাড়ির শিশু-কিশোরদের সেই আসরে প্রবেশাধিকার ছিল না। এদিকে শিশু উত্তম এক আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করতেন খুড়ো জ্যাঠাদের অভিনয় দেখার। লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের রিহার্সাল দেখতেন অরুণ। এই নিষিদ্ধ আনন্দের কথা সে বাদে জানত তার একমাত্র দিদি, পুতুল। নিজের খেলনা ইত্যাদি দিদিকে অকাতরে দিয়ে একপ্রকার চুক্তি করে এ তথ্য বড়দের থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। যাত্রার রিহার্সাল দেখতে উত্তেজিত অরুণ হুবহু সেই দৃশ্যগুলি অভিনয় করে দেখাত তার পুতুলদিকে। ছোট ভাইটির প্রতি দিদির ছিল প্রগাঢ় প্রশ্রয়, তাই উৎসাহ দেওয়ায় কমতি ছিল না। ১৯৩০ নাগাদ হঠাৎ নিউমোনিয়া এবং টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পুতুলদি'র অকালপ্রয়াণ ঘটে। এই প্রথম মৃত্যুশোক আজীবন ভুলতে পারেননি উত্তমকুমার। সময়ের সঙ্গে শোকের গভীরতা কমে আসে, ১৯৩১-এ ছোটভাই তরুণকুমারের জন্মের পর পুতুলের অকাল প্রয়াণের শোক কিছুটা প্রশমিত হয়। আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে চট্টোপাধ্যায় পরিবার, কিন্তু ফের অঘটন! একদিন রাত্রে লুকিয়ে বড়দের রিহার্সাল দেখতে গিয়ে জ্যাঠামশাই অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল অরুণ! অভিনয়ের শখ ঘুচে গেল বুঝি। যা থাকে কপালে ভেবে সত্যিটাই বলে ফেলল সে। হুবহু মুখস্থ বলেও দিল খুড়ো-জ্যাঠাদের বহু অভিনয়াংশ । সকলকে অবাক করে শিশু অরুণকে বড়দের অভিনয় দেখার ছাড়পত্র দিলেন তার জ্যাঠামশাই! অরুণের অভিনয় জীবন পেল নতুন বাঁকের সন্ধান। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরবর্তীতে কতকটা অরুণের জ্যাঠামশাইয়ের আদলেই সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘নায়ক’ ছবিতে শঙ্করদা’র চরিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন।)
বড়দের দেখাদেখি বাড়ির ছোটদের এবং পাড়ার মুখার্জি পরিবারের খুদে সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠল 'লুনার ক্লাব'। অল্পদিনের মধ্যেই অভিনীত হল তাদের প্রথম নাটক । প্রথম কোন নাটক অভিনীত হয়েছিল সে নিয়ে অবশ্য দ্বিমত রয়েছে। 'তালসুর' এবং রবীন্দ্রনাথের 'মুকুট' এই দুটির মধ্যে ক্রমানুযায়ী একটি ছিল লুনার ক্লাবের প্রথম অভিনয়। 'মুকুট' এর অভিনয় হয়েছিল রীতিমতো স্টেজ সাজিয়ে, পোশাক, সাজসজ্জা তৈরি করে। অরুণের অভিনয় দেখে তাকে রীতিমতো প্রশংসা করেন অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়। তখন অরুণ ও তার দুই ভাই চক্রবেড়িয়া স্কুলের ছাত্র। অপ্রত্যাশিত ভাবে স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের নাটক 'গয়াসুর'-এ 'ছোট গয়াসুর' এর ভূমিকায় সুযোগ পেলেন অরুণ। আত্মবিশ্বাস এবং যাত্রাভিনয়ের অভিজ্ঞতা তাকে খালি হাতে ফেরাল না। নাটকের বারোটা দৃশ্যের মধ্যে আটটিতেই অভিনয় ও গানের যুগপৎ পরিবেশন তাকে এনে দিল তিনটি মেডেল! ভবিষ্যতের অভিনেতা উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনের সেটিই ছিল প্রথম পুরস্কার। এই সাফল্যের পর অরুণের সাংস্কৃতিক শ্রমিক হয়ে ওঠার পর্ব হয়ে উঠল ঘটনাবহুল। একদিকে লাগাতার মঞ্চে অভিনয়ের চর্চা, সেইসঙ্গে খেলাধুলো, সাঁতার শেখা। শরীরচর্চাকে অভিনয়ের অন্যতম শর্ত হিসেবে তখন থেকেই মেনে চলতেন অরুণ। একদিন ডাক এল জেঠামশাই অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে। কী ব্যাপার? না সুহৃদ সমাজ বেশ বড় আকারে মঞ্চস্থ করতে চলেছে যাত্রাপালা ‘ব্রজের কানাই’, তাতে কিশোর বলরামের চরিত্রে কারোর অভিনয়-ই পছন্দ হচ্ছে না নির্দেশক ফণী রায়ের।
আরও পড়ুন
'শেষ পঞ্চাশ' পঞ্চম পর্ব : কলকাতা শহর যদি ‘গথাম’, ‘ব্যাটম্যান’ তবে উত্তমকুমার
সে যুগের বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ও নির্দেশক ফণীবাবু একরকম ভালো লাগা থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন সুহৃদ সমাজে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে মুখ রক্ষা করাই যে দায়! অতএব কিশোর বলরামের চরিত্রে অরুণের কথাই ভাবা হয়েছে। অরুণ হতবাক! এ তো মেঘ না চাইতেই জল। বড়দের পরিসরে প্রবেশাধিকারের পাঁচিল আপনা হতেই সরে গেল। তবে দায়িত্বও অনেক। ফণী রায়ের কাছে পরীক্ষা দিল সে। সসম্মানে উত্তীর্ণও হল। ফণী রায় সম্ভাবনা দেখেছেন তার মধ্যে। এ কথা আড়াল থেকে শুনেছে সে। রাতদিন ধরে চলল মহড়া, এসে গেল চূড়ান্ত দিন। চরম উত্তেজনা। বড়দের নাটকে তাবড় তাবড় অভিনেতার মধ্যেও লাঙল কাঁধে কিশোর বলরামের অভিনয় এবং গান নজর কাড়ল সব্বার। অভিনয় শেষে আনন্দের চোটে বলরামবেশী অরুণকে জড়িয়ে ধরলেন তার জ্যাঠামশাই। অভিনেতা ফণী রায় আশীর্বাদ করলেন তার মাথায় হাত রেখে "তুমি একদিন অনেক বড় অভিনেতা হবে। আমি তোমার মধ্যে আমি প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করছি।"
ভবিষ্যতে এই কথা কোন উচ্চতায় গিয়ে সত্যি হয়েছিল উত্তম-জীবনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে শুধুমাত্র স্বীয় প্রতিভার উপরে ভরসা করেনি ভবানীপুরের সেই ছেলেটি, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাংস্কৃতিক বাতাবরণের মধ্যে থেকেও সে বজায় রেখেছিল শ্রমিকের মতো আত্মোন্নতির নিরলস প্রয়াস এবং মূল্যবোধের প্রতি নিষ্ঠা। কাঙ্খিত আসন অতি সহজে হস্তগত হয়নি তার। প্রস্তুতি-পর্বের সেই দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা না হয় আর কোনোদিন বলা যাবে।
আরও পড়ুন
হিন্দি সিনেমায় ব্যর্থ হলেন ‘বহিরাগত’ উত্তমকুমার, ষড়যন্ত্রে জড়িত বলিউডের রথী-মহারথীরাও?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১)আমার আমি- উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং (১৯৮০)
২)আমার দাদা উত্তমকুমার – তরুণকুমার, সাহিত্যম (২০০৮)
৩)অচেনা উত্তম- চন্ডী মুখোপাধ্যায়, প্রতিভাস (২০১৬)
৪) চিত্রভাষ - বিশেষ উত্তমকুমার সংখ্যা (২০০২)
৫) আনন্দলোক- উত্তমকুমার স্মরণ সংখ্যা (১৬ আগস্ট ১৯৮০)
৬) স্মৃতির আলোয় মহানায়ক উত্তমকুমার ,এইএমভি কর্ত্তৃক প্রকাশিত স্মারক সংকলন *
*অভিনেতা দেবরাজ রায় গৃহীত উত্তমকুমারের নিকটজনদের বিবিধ সাক্ষাৎকার।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
উত্তমের চোখে তখন আদর্শ নায়ক অসিতবরণ, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ইচ্ছে বিমল রায়ের মতো পরিচালক হবেন