হাইস্কুলের গণ্ডিও পেরনো হয়নি তাঁর। তখন বড়োজোর পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শ্রেণি। অর্থনৈতিক অভাবের কারণে ছাড়তে হয়েছিল পড়াশোনা। সেইসঙ্গে সংসারের ভার এসে পড়েছিল তাঁর কাঁধে। কাজের সন্ধানে জন্মভিটে হরিয়ানা ছেড়ে দিল্লিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন রিক্সাচালকের ভূমিকা। সেখান থেকেই আজ দেশের অন্যতম কৃষি উদ্ভাবক হয়ে উঠেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন দেশের অন্যতম উদ্যোগপতি।
ধরমবীর সিং কাম্বোজ (Dharambir Singh Kamboj)। হরিয়ানার (Haryana) ৫৯ বছর বয়সি উদ্ভাবকের ব্যক্তিগত জীবন অবাক করার মতোই। এ যেন এক স্বপ্নের উত্থান। ভাগ্যের সহায়তা তো ছিলই, তবে কঠোর পরিশ্রম এবং জ্ঞানপিপাসাই তাঁকে আজ পৌঁছে দিয়েছে এই জায়গায়।
৮০-র দশকে রাজধানীতে থাকার সময়, পুরনো দিল্লি রেলস্টেশনের কাছেই মূলত কাজ করতেন ধরমবীর। সে-সময়ই তিনি সন্ধান পান স্টেশন লাগোয়া একটি পাবলিক লাইব্রেরির। কাজে ফাঁকে সুযোগ পেলেই লাইব্রেরিতে গিয়ে হাজির হতেন তিনি। পড়তেন কৃষি-সংক্রান্ত নানান বিষয়ের গ্রন্থ। ব্রকলি, অ্যাসপারাগাস, লেটু কিংবা বেল মরিচের মতো বিভিন্ন বিদেশি ফল ও ফসল কীভাবে চাষ করা যায়, কীভাবে তা দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে— এই সবকিছু নিয়েই কম-বেশি গবেষণা করেছেন তিনি।
নব্বই-এর দশকের শেষের দিকে দিল্লির রাস্তায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হন ধরমবীর। সে-সময় প্রায় ৬ মাস শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। ছাড়তে হয় রিক্সাচালনার জীবিকাও। ফিরতে হয় হরিয়ানায়। নিজের গ্রামে ফিরে কৃষিকাজেই মনোনিবেশ করেন ধরমবীর। গ্রামোন্নয়ন সমিতিতে সুযোগও পেয়ে যান প্রশিক্ষক হিসাবে। গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের কৃষি পদ্ধতি বদল আনার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি।
আরও পড়ুন
বছরভর জলের তলায় কৃষিজমি, চাষাবাদ ছাড়ছেন হরিয়ানার অধিকাংশ কৃষক!
২০০৪ সালে সেই সূত্রেই হরিয়ানার উদ্যানপালন বিভাগ রাজস্থানের একটি কৃষি সম্মেলনে পাঠায় তাঁকে। মূলত, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের উপরেই আলোচনা হয়েছিল সেই সভায়। তবে যেসব যন্ত্রপাতির কথা সেখানে উঠে আসে, সেগুলির দাম প্রায় ৪-৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু প্রান্তিক ভারতের দরিদ্র কৃষকদের কাছে কি আদৌ সামর্থ্য রয়েছে এমন যন্ত্র কেনার?
আরও পড়ুন
কৃষিক্ষেত্রে প্যাথোজেনের আক্রমণ ঠেকাবে ন্যানোপার্টিকল, অভিনব আবিষ্কার কানপুর আইআইটির
এরপরই শুরু হয় তাঁর ভিন্ন এক লড়াই। শুরু হয় প্রযুক্তিবিদ্যা এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা। দীর্ঘ ৮ মাস চেষ্টার পর অবশেষে তিনি সফল হন বহুমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রের প্রোটোটাইপ তৈরিতে। একই সঙ্গে একাধিক কাজ করতে সক্ষম তাঁর এই যন্ত্র। তা একদিকে যেমন দানা শস্য বাছাই করতে পারে, তেমনই তেল নিষ্কাশন করতে পারে রাঢ়ি কিংবা সরিষা থেকেও।
আরও পড়ুন
জলমগ্ন জমিতে ‘ভাসমান’ কৃষিকাজ, বিকল্পের খোঁজে বাংলার চাষিরা
২০০৬ সালে এই যন্ত্রের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পেটেন্ট আদায় করেন ধরমবীর। তারপর শুরু হয় বাণিজ্যিক উৎপাদন। ভারত তো বটেই স্বল্পমূল্যের এই যন্ত্র আজ বাজার দখল করেছে অস্ট্রেলিয়া, কেনিয়া, নেপাল, ইতালি, নাইজেরিয়া, জিম্বাবুয়ের মতো ১৫টি দেশে। এমনকি সেই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। পেয়েছেন একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও।
একটা সময় তাঁর এই গবেষণা, প্রচেষ্টা সমালোচিত হয়েছে গোটা গ্রামে। কেউ কেউ বলেছেন, এসবই পাগলের প্রলাপ। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর বাবাও। তবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তাঁর এই সাফল্য অনুপ্রাণিত করে যে কাউকেই…
Powered by Froala Editor