পিঠে খাবারের ব্যাগ। রোদ-বৃষ্টি মাথায় করেই শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে চলেছেন সদ্য কৈশোর পেরোনো এক যুবক। লোকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন ফাস্টফুড। আবার তার ফাঁকেই জিরিয়ে নিচ্ছেন রাস্তার ধারের বেঞ্চে। টিফিন বাক্স থেকে বের করে আনছেন বাড়িতে তৈরি সস্তা স্যান্ডউইচ।
বছর কয়েক আগে এটাই ছিল তাঁর রুটিন। সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়েই পিৎজা ডেলিভারি করতে হত তাঁকে। আজ বিশ্বকাপের মঞ্চে ফ্রান্সের অন্যতম তুরুপের তাস তিনি। ইউসুফ ফোফানা (Youssouf Fofana)। না, ধারাবাহিকভাবে ফ্রান্সের প্রথম একাদশে যে খেলেন এমনটা একেবারেই নয়। তবে চলতি বিশ্বকাপে ফেভারিট হলেও ‘ভাঙা’ দল নিয়েই কাতারে পাড়ি দিতে হয়েছে ফ্রান্সকে। স্কোয়াডে নেই ব্যালান ডি’ওর-জয়ী স্ট্রাইকার করিম বেঞ্জিমা। চোটের জন্য বাদ পড়েছেন এনগোলো কন্তে, পল পোগবার মতো ঘাতক মিডফিল্ডারও। আর সেই অভাব পূরণ করতেই ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেঁশ বেছে নিয়েছেন ইউসুফকে।
চলতি বিশ্বকাপে ইতিমধ্যেই চারটি ম্যাচে খেলে ফেলেছেন ২৩ বছর বয়সি তরুণ ফ্রেঞ্চ তারকা। তার মধ্যে ৩টি ম্যাচে সাবস্টিটিউট হিসাবে নামলেও, তাঁর শৈল্পিক টাচ, উইং থেকে বাড়ানো ক্রস নজর কেড়েছে দর্শকদের। অন্যদিকে টিউনিশিয়ার ম্যাচে তিনি শুরু থেকে খেললেও, ১-০ ব্যবধানে সেদিন হারতে হয়েছিল ফ্রান্সকে। অবশ্য সেটার জন্য এতটুকু আত্মবিশ্বাস হারাননি ফোফানা।
ফোফানার এই উত্থানও একপ্রকার স্বপ্নের মতোই। ছোটোবেলাতেই যে ফুটবলের জগতে দুরন্ত আত্মপ্রকাশ হয়েছিল তাঁর, এমনটা একেবারেই নয়। বরং, ফুটবল ছিল ফোফানার ব্যক্তিগত ভালোবাসা। প্রথম প্রেম। আর সেই প্রথম প্রেমের পিছু করতে করতেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের অ্যামেচার অ্যাকাডেমি ক্লেয়ারফন্টেইনে। ফুটবল যে কোনোদিন তাঁর অন্ন-সংস্থান জোগাবে, তেমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি ফোফানা। তাই খেলার পাশেপাশেই চলত বিকল্প জীবিকার অনুসন্ধান। অবশ্য খেলা ছাড়তে নারাজ ছিলেন তিনি। সেই কারণেই ডেলিভারি বয়ের চাকরিকে বেছে নেওয়া। যাতে অনুশীলনের সময়সূচীকে বাঁচিয়েই কাজ চালিয়ে যাওয়া যায় ক্রমাগত।
২০১৭ সালে তাঁর কাছে অফার আসে স্ট্রাটসবর্গের বি-দলের। বছর দুয়েক সেখানে খেলার পর মূল দলে সুযোগ পান ফোফানা। অনেকটা স্বপ্নের মতোই ছিল সেই অভিযান। পেশাদার ফুটবলের ছাপ পড়ে তাঁর জার্সিতে। অর্থাৎ, যে-বয়সে এমবাপে দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন, সেই বয়সে প্রথম পেশাদার ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছিল ফোফানার। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবেই খেলছেন ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণির লিগ ‘লিগা-১’-এ। মুগ্ধ করছেন ফরাসি ফুটবলপ্রেমীদের। স্ট্রাটসবর্গ ছেড়ে এখন তাঁর গায়ে মোনাকোর জার্সি। অবশ্য ফুটবল তাঁকে সবচেয়ে বড়ো চমক দেয় চলতি বছরের শুরুতে। ফ্রান্সের জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ আসে তাঁর কাছে। দেশের হয়ে খেলেছিলেন মাত্র ৩টি ম্যাচ। তবে তা সত্ত্বেও বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে জাতীয় শিবিরে সুযোগ পাওয়া তো একপ্রকার স্বপ্নের মতোই।
এর আগেও অর্থনৈতিক পিরামিডের নিচুর তলা থেকে একাধিক আন্তর্জাতিক ফুটবলার উঠে এসেছে ফরাসি দলে। কিংবদন্তি ফ্রেঞ্চ উইঙ্গার ও বায়ার্ন-তারকা ফ্র্যাঙ্ক রিবেরি ছিলেন সামান্য নির্মাণকর্মী। পোশাকের দোকানে কাজ করতেন দিমিত্রি পায়েত। এনগোলো কন্তেও তাই। বাঁধা-ধরা চাকরি সামলেও স্রেফ ফুটবলকে ভালোবেসেই তাড়া করে গেছেন স্বপ্নকে। এবার সেই তালিকাতেই নতুন করে নাম লিখিয়েছেন ইউসুফ ফোফানা।
Powered by Froala Editor