দেখতে অনেকটা তাসের মতোই। তবে সেখানে সাহেব, বিবি, গোলাম কিংবা নম্বরের বদলে ছাপা ফুটবল খেলোয়াড়দের ছবি। কত সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন তাঁরা, কবার বল পাঠিয়েছেন তে-কাঠির নিচে, কটি অ্যাসিস্ট করেছেন— এসব তথ্যও লেখা আছে ছবির নিচে। নব্বইয়ের দশকে যাঁদের বড়ো হয়ে ওঠা, এহেন কার্ড ছিল তাঁদের কৈশোরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনও একতাড়া কার্ডের মধ্যে থেকে দু-একটা কার্ড হারিয়ে গেলে অনায়াসে ক্রিকেটারদের কার্ড দিয়ে সেই শূন্যস্থান ভরার প্রচলনও ছিল সে-সময়কার স্কুল পড়ুয়াদের। আর সেভাবেই কখনও কাকার স্থানে জায়গা করে নিতেন তেন্ডুলকার, কখনও আবার জিদানের জায়গায় পন্টিং। তাতে ৫২ কার্ডের হিসেব মিলত ঠিকই, তবে মাথাচাড়া দিত কিছু আশ্চর্য প্রশ্নও। সত্যিই সত্যিই যদি ভিন্ন পেশার মানুষদের নামিয়ে দেওয়া হয় ফুটবলের মাঠে, তবে কোন পজিশনে খেলবেন তাঁরা?
এই প্রশ্নের উত্তরই একটু অন্যভাবে খুঁজেছিলেন দুই খ্যাতনামা লেখক এবং শিল্পী। কথা হচ্ছে মাইক ম্যাকিনেসের (Mike McInnes) লেখা গ্রন্থ ‘ম্যান দ্য সকারপ্লেয়ার— হোমো পেসিয়েন্স’-কে (Man The Soccer Player - Homo Passiens) নিয়ে। ফুটবল বিষয়ক এই বিচিত্র বইটিকে সারিয়ালিস্ট বললে ভুল হয় না এতটুকু। মানুষের বিবর্তনকে একটু অন্যভাবেই দেখেছেন মাইক। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে হোমো সেপিয়েন্স আসলে ফুটবল খেলার জন্যই বিবর্তিত হয়েছে আজকের শারীরিক গঠনে! মজার ছলে তার নানাধরনের প্রমাণও দিয়েছেন তিনি। তবে এসবের বাইরে যেটা সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়, তা হল বিশ্বের একগুচ্ছ শিল্পীকে ফুটবলারের চরিত্রে চিত্রায়ণ।
সেই একাদশে যেমন রয়েছেন সালভাদোর দালি, ফ্রিডা কাহলো, ম্যাক্স আর্নেস্টের মতো সারিয়ালিস্ট শিল্পীরা। তেমনই সেখানে জায়গা করে নিয়েছেন ফ্রানৎস কাফকা, স্যামুয়েল বেকেটের মতো লেখক, জঁ পল সার্ত্রের মতো নাট্যকার। ‘সারিয়ালিস্ট ফুটবল একাদশ’-এর কার্ডগুলির নকশা তৈরি করেছিলেন লেখক মাইকের বন্ধু ও সহকর্মী শিল্পী ম্যাট কেনিয়ন। অন্যদিকে এই একাদশ অশ্বারোহী ফুটবল মাঠের কোন কোন পজিশনে খেলবেন, সেটি ঠিক করেন মাইক। গোটা ব্যাপারটা মনগড়া হলেও, কাফকা-দালি-ফ্রিডা-সার্ত্রের বিভিন্ন উক্তি কিংবা লেখার অংশ বিবেচনা করেই তাঁদের পজিশন ঠিক করেছিলেন তিনি।
তবে বিষয় হল, আশ্চর্য এই কাজটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের যোগও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এককথায় রসাতলে তলিয়ে গিয়েছিল শিল্প। নিজেদের মেলে ধরার স্বাধীনতা হারান বহু শিল্পী। হাতে বন্দুক ধরিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল অজস্র নাম না জানা ছোটো-বড়ো শিল্পীকে। সে-সময় প্রাণ বাঁচাতে বহু শিল্পী পালিয়ে গিয়েছিলেন মার্সেই শহরে। সেখানে আন্দ্রে ব্রেটনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের একটি গোপন সংগঠন। নিভৃতে শিল্প চর্চা হত প্রতি রবিবার। তাঁর নেতৃত্বেই শুরু হয়েছিল একটি আশ্চর্য খেলা। কোনো ঘটনাকে পৃথক অন্য একটি ঘটনার মোড়কে সারিয়ালিস্টভাবে ক্যানভাসে উপস্থাপন করতে হত শিল্পীদের।
ব্রেটনের এই পরিকল্পনাই পরবর্তীতে উদ্বুদ্ধ করে লেখক মাইক এবং তাঁর শিল্পী বন্ধু ম্যাট কেনিয়নকে। ২০১৭ সালে ‘হোমো পেসিয়েন্স’ বইটির সঙ্গেই পৃথকভাবে সংযুক্ত করা হয় ১১ সারিয়ালিস্ট ফুটবলারের কার্ড। ম্যাট এবং মাইক দু’জনেরই বিশ্বাস ফুটবল আদতে একটি পরাবাস্তব খেলা। অনুরাগীরা যখন ফুটবল ম্যাচ দেখেন, তখন তাঁদের মাথায় তৈরি হয় এক বিশেষধরণের ব্রেইনওয়েভ। যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্বপ্নের জগতে ঠেলে দেয় তাঁদের। ফিফা বিশ্বকাপের এই মরশুমে সকলেই নিজের নিজের মনে এমন সারিয়ালিস্ট জগতের মায়াজাল বুনে চলেছেন, তা বলার অপেক্ষা থাকে না…
তথ্যসূত্রঃ
১. Fantasy football: a kickabout with the surrealists – in pictures, Kathryn Bromwich, The Guardian
২. Man the Soccer Player--Homo Passiens: The Missing Link in Human Evolution, Mike McInnes
Powered by Froala Editor