চাকরি নেই, বন্ধ কল-কারখানা, সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি তো রয়েইছে। আর এসবই কথাই ভাষা পাচ্ছে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে। ভোটের ঠিক আগের মুহূর্তে দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরছেন তরুণ বামপন্থীরা। হাতিয়ার শিল্প। ছবি আর কথার সমানুপাতিক মেলবন্ধনে চলছে অভিনব এক প্রচার। প্রথাগত দেওয়াললিখনের থেকে একটু আলাদা করেই যা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে মানুষের। কিন্তু এইসব ছবি শিল্পী কে বা কারা?
তৌসিফ হক। সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারী সকলেই প্রায় পরিচিত এই নামটির সঙ্গে। কার্টুন, ক্যালিগ্রাফি, ভাঙা ভাঁড় সাজিয়ে প্রতিকৃতি তৈরি হোক কিংবা ছবি— বিগত কয়েক বছর ধরেই নেট দুনিয়ায় একের পর এক মনমুগ্ধ করা শিল্পশৈলী উপহার দিয়েছেন তিনি। বহুবার তাঁর ছবিতে ফুটে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। নির্বাচনের ঠিক প্রাক্বালেও অন্যথা হল না তার। তুলি, থুড়ি ডিজিটাল আর্টকে হাতিয়ার করেই ‘দেওয়াললিখন’-এর কর্মসূচি নিয়েছেন শিল্পী।
ঠিক বোধগম্য হল না নিশ্চয়ই? ভাবছেন ডিজিটাল ছবির সঙ্গে কীভাবে আসছে দেওয়াল লিখনের প্রসঙ্গ? আসলে নির্বাচনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শিল্পী তৌসিফ হকের আঁকায় ফুটে উঠছিল সাধারণ মানুষের কথা। সেই সিরিজ ছবি আসলে ডিজিটালিই তৈরি করা। পরে তাঁর বানানো ছবিগুলিকেই অনুকরণ করে দেওয়াললিখন ফুটিয়ে তোলেন তরুণ বামকর্মীরা। সারা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের দেওয়ালে বর্তমানে ছড়িয়ে রয়েছে তারা।
“এই ছবিগুলো দিয়ে যে দেওয়াললিখন হবে, প্রথমে তেমনটা ভাবিনি। আমার মনে হয়েছিল ভোটের আবহে কিছু কাজ করা যাক, যা দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনো যেতে পারে। বলতে গেলে বামদলগুলোর মধ্যে হেভিওয়েট ব্যাপারটা তো খুব কম। কোনো তারকা নেই, কিছু নেই। একঝাঁক তরুণ ছেলে-মেয়ে গত দু-এক বছর ধরে ধারাবাহিক কাজ করে আজ একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের কথা কে বলবে? আমার মনে হয় সেটার দায়িত্ব রয়েছে শিল্পীদের, কবিদের। সেই ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগের শুরু…”
আরও পড়ুন
চিত্তপ্রসাদে সাজছে দেওয়াল, ছবিতে মেহনতি মানুষের লড়াই
প্রতি দলেরই কিছু ইস্তেহার থাকে। আর সেই ইস্তেহারের কথাগুলোই যেন সহজ-সরল করে শিল্পের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। ধারাবাহিকভাবে কাজগুলো নিজের সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন তৌসিফ। তারপর সেসব ছবি, নিজেরাই পথ খুঁজে নিয়েছে দেওয়ালের। “বেশ কিছু বাম সমর্থক এবং কর্মী, তাঁরাই ছবিগুলো দেখে দেওয়াললিখনের উদ্যোগ নেন। আমি ফেসবুকে বলেও ছিলাম, এই ছবিগুলো ব্যবহারের জন্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই কোনো। আসলে এটা পিপলস আর্ট। একজন কনসেপ্ট এঁকে দিচ্ছে। একজন রং করছে। আবার বছর কুড়ির ছেলে-মেয়েরা তুলি নিয়ে তাঁদের কথা লিখছে। এটা বিভিন্ন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।”
শিল্পীর কথা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে বামপন্থী রাজনীতির মূলমন্ত্রকেই। গণশিল্পকে। গণনাট্যই হোক কিংবা গণসঙ্গীত— বাম রাজনীতিতে বারবার প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠে এসেছে শিল্প। এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আরও একবার সেই কথাই যেন মনে করিয়ে দিলেন তৌসিফ, “আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি বাম দলগুলি দেওয়াললিখনে একটি বিশেষ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছে। সেসময় বিভিন্ন কার্টুন থেকে শুরু করে ছড়া, প্যারোডি অনেক কিছু হয়েছে। সেটা এখনও বামপন্থীরা বজায় রেখেছেন।”
আরও পড়ুন
চিনেভাষায় 'খেলা হবে', ভোটের দেওয়াল জুড়ে 'চিনে কলকাতা'
তবে শুধুই কি দেওয়াললিখন? একাধিক বাম-প্যারোডিতেও ব্যবহৃত হয়েছে শিল্পী তৌসিফ হকের ছবি। এমনকি, বিভিন্ন গ্রাফিক্স কার্ডেও। যার মধ্যে ধরা পড়েছে এক নতুন বসন্তের ছবি, দিনবদলের স্বপ্ন। আর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া? “দেখো, যখন রাজনৈতিক দলের যখন দেওয়াল লেখা হয়, তখন সাধারণ মানুষের একটা মানসিকতা থাকে যে বাবা আমি এসব সাতে-পাঁচে থাকব না। তবে আমাকে অনেকেই ইনবক্সে বলেছে যে আমরা যখন ছবি করছিলাম তখন বহু মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে। আসলে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসেছে বলেই আরও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সাধারণের”, জানেলেন তৌসিফ হক।
ভোটের ফলাফল অনেক দূরের কথা। তবে ছবিই হোক কিংবা পথনাটিকা— শিল্পই এখন তরুণদের হাতিয়ার লড়াই করার। দিনবদল আসা, না-আসা সরিয়ে এক নতুন স্বপ্নের মায়াজাল বুনছেন তাঁরা। এ যেন সত্যিই এক ‘নবজাগরণ’…
আরও পড়ুন
বাংলা হরফ আর ছবিতে বিশাল দেওয়ালচিত্র, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াই মিশিগানে
Powered by Froala Editor