আজ থেকে ঠিক ৬৫ বছর আগের কথা। ফ্রান্সকে প্রথমবার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক ২৪ বছর বয়সি তরুণ। না, ককেসিয়ান নন মোটেই। বরং, তিনি ছিলেন ফরাসি বংশোদ্ভূত। বাবা ফরাসি হলেও, মা ছিলেন ফ্রান্স অধিকৃত মরক্কোর বাসিন্দা। কৈশোর থেকেই তাঁকে লড়তে হয়েছিল দারিদ্রের সঙ্গে। এমনকি বিশ্বকাপের মঞ্চে অনুশীলন করতে গিয়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল তাঁর একমাত্র বুট জুতো। ছিল না নতুন জুতো কেনার সামর্থ্য। তা সত্ত্বেও সতীর্থের থেকে ধার করা বুট পরেই সোনা ঝরিয়েছিলেন তিনি। এক বিশ্বকাপেই করেছিলেন ১৩টি গোল। সাড়ে ছ’দশক পেরিয়ে এসে আজও এই রেকর্ড স্পর্শ করতে পারেননি দ্বিতীয় কোনো তারকা।
জাস্ট ফন্টাইন। ফরাসি উচ্চারণে জা ফঁতে (Just Fontaine)। ফরাসি ফুটবলার (French Footballer) সর্বকালীন সেরা ‘গোলমেশিন’ হিসাবেই বিবেচিত হন তিনি। বুধবার ৮৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ফরাসি কিংবদন্তি। সম্প্রতি ফরাসি ফুটবল ক্লাব পিএসজি নিশ্চিত করে তাঁর মৃত্যু সংবাদ। এমন এক কিংবদন্তি ফুটবলারের প্রয়াণে ইতি পড়ল আন্তর্জাতিক ফুটবলের আরও একটি বর্ণময় অধ্যায়ে।
১৯৩৩ সাল। ফন্টাইনের জন্ম মরক্কোর মারাকেচ শহরে। এমনকি তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের শুরুতাও হয়েছিল মরক্কোতেই। ১৯৫০ সালে তিনি নাম লেখান সে-দেশের ফরাসি ক্লাব ‘ইউএসএম কাসাব্ল্যাঙ্কা’-তে। খেলেছিলেন তিন বছর। সে-সময় মরক্কান ফুটবল লিগে রাজত্ব ফ্রান্সের শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের। তাঁদের বেতনও ছিল স্থানীয়দের থেকে অনেক বেশি। তবে সেই ভিড়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন ফন্টাইন। মাত্র ৪৮টি ম্যাচে ৬২টি গোল করে নজর কেড়েছিলেন ফরাসিদের।
সেই সূত্র ধরেই ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সে আসা। সুযোগ পেয়েছিলেন প্রথম ডিভিশন ফরাসি ক্লাব নিস-এ। সেইসঙ্গে ফ্রান্সের জাতীয় দলে খেলার সুযোগও চলে আসে তাঁর কাছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, ফ্রান্সে এসেও অর্থনৈতিক হাল তেমন বদলায়নি তাঁর।
সে যাই হোক, ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সের মাটিতে পা রেখেই এক নতুন নজির গড়েছিলেন ফন্টাইন। গোটা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিলেন নতুন এক শক্তির উত্থানের। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ১৭ ডিসেম্বর। অভিষেক ম্যাচেই লুক্সেমবার্গের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের জার্সিতে হ্যাটট্রিক করেন ফন্টাইন। জাতীয় দলে ফন্টাইনের এই গোলস্পৃহা অক্ষত ছিল তাঁর কেরিয়ারের শেষ পর্যন্ত।
অবশ্য আজকের দিনের আর পাঁচটা ফুটবলারের মতো দীর্ঘ কেরিয়ারের ভাগীদার হতে পারেননি তিনি। চোটের কারণে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই তুলে রাখতে হয়েছিল বুটজোড়া। তবে তার মধ্যেই একাধিক নজির গড়েছেন তিনি। যার মধ্যে ১৯৫৮-র বিশ্বকাপের কথা না উল্লেখ করলেই নয়।
সে-বার ফ্রান্সের শিবিরকে একক দক্ষতাতেই বিশ্বকাপের মঞ্চে সেমি-ফাইনালে তুলেছিলেন ফন্টাইন। উল্লেখ্য, সেটাই ছিল ফ্রান্সের প্রথম সেমি-ফাইনাল অভিযান। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ফন্টাইন গোলের ঝড় তুললেও, সেবার ফ্রান্সকে বশ্যতা মানতে বাধ্য হতে হয়েছিল ব্রাজিলের কাছে। ৫-২ গোলে হেরে বিশ্বজয়ের দৌড় থেকে ছিটকে যায় ফ্রান্স। সেই ম্যাচেই উত্থান হয়েছিল আরেক ১৭ বছর বয়সি তরুণ তারকার, পেলে। সে-ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি।
তবে ব্রাজিল কাপ ঘরে তুললেও, বিশ্বরেকর্ডের পাতায় নাম লিখিয়েছিলেন ফন্টাইন। দুটি হ্যাটট্রিক-সহ ১৩টি গোলের সেই রেকর্ড অক্ষত আজও। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আজকের ফর্ম্যাটে কোনো ফাইনালিস্ট দলের খেলোয়াড়কে এই রেকর্ড স্পর্শ করতে ধারাবাহিকবাহে ২টি করে গোল করতে হবে প্রতি ম্যাচে।
উল্লেখ্য, ১৯৫৮-র সেই বিশ্বকাপই শেষ বিশ্বকাপ হয়ে রয়ে যায় ফন্টাইনের। তার মাত্র ৩ বছর পরেই বুট তুলে রাখতে হয় তাঁকে। তা সত্ত্বেও, মাত্র ৭ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ২১ ম্যাচে ৩০টি গোল রয়েছে তাঁর। ক্লাবের জার্সিতে ২৮৩ ম্যাচে করেছেন ২৫৯টি গোল। ফরাসি ক্লাব রিমসকে এনে দিয়েছেন দুটি লিগ ট্রফি, ইউরোপিয়ান ক্লাবের রানার্স-আপ শিরোপা।
ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর, পিএসজি-সহ ফ্রান্সের একাধিক প্রথম শ্রেণির ক্লাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ফন্টাইন। ছিলেন ফ্রান্সের জাতীয় দলের প্রশিক্ষকও। তবে মাত্র ২টি ম্যাচের জন্য। সংশ্লিষ্ট ম্যাচ দুটিতে জাতীয় দলের হারের জন্যই বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। পরবর্তীতে মরক্কোর জাতীয় দলে কোচিং করিয়েছেন ফন্টাইন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই আফ্রিকান কাপে প্রথমবার তৃতীয় স্থান দখল করেছিল অ্যাটলাসের সিংহরা। সবমিলিয়ে ‘গোলমেশিন জাস্টো’-কে ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যায় ফুটবলের ইতিহাস। ২০১০ সালে সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলেও বিশ্বের সেরা ১০ ঘাতক স্ট্রাইকারের তালিকায় জায়গা দিয়েছিলেন ফন্টাইনকে।
মাস দুয়েক আগে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রয়াত হন পেলে। এবার আরও এক কিংবদন্তি ফুটবলারের মৃত্যুতে যেন আরও খানিকটা বর্ণহীন হয়ে গেল ফুটবল-জগৎ…
Powered by Froala Editor