জনহীন ধুধু প্রান্তর। চিহ্নমাত্র নেই পশু-পাখির। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। আন্টার্কটিকা। সেখানেই তাঁর অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা। দিনের পর দিন গবেষণার কাজ। সারাদিনের কাজের পর দু’দণ্ড বিশ্রামের জন্য ইজিচেয়ারে হুইস্কি নিয়ে বসেছিলেন। মজার ছলেই, মহাদেশ-জুড়ে জমে থাকা বরফের চাদর থেকে এক টুকরো খণ্ড কেটে গ্লাসে দিয়েছিলেন তিনি। আর তাতেই হয়ে গেল ম্যাজিক। আশ্চর্য হয়ে তিনি লক্ষ করেছিলেন, বরফের খণ্ডটির গলনের ফলে গ্লাসের মধ্যে অনর্গল তৈরি হচ্ছে বুদবুদ। ফ্রিজে জমানো বরফের ক্ষেত্রে যেমনটা হয় না একাবারেই।
আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগের কথা। ১৯৬৫ সাল। এমনই নিতান্ত একটি ঘটনা থেকেই খুলে গিয়েছিল পরিবেশবিদ্যার একটি নতুন দিগন্ত। ক্লাইমেটোলজি। জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়নের পিছনে আদতে যে মানুষই দায়ী— সে-কথাও প্রমাণিত হয়েছিল এই অতিসাধারণ ঘটনা থেকেই। নেপথ্যে ফরাসি হিমবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদ ক্লদ লরিয়াস (Claude Lorius)।
বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি গবেষক। আজ ৯১ বছর বয়সে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফরাসি বিজ্ঞানী।
১৯৩২ সালে ফ্রান্সের বারগেন্ডিতে জন্ম ক্লদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শেষ করার পরই ক্লদের কাছে সুযোগ আসে আন্টার্কটিকা অভিযানের। সে-সময় গোটা বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমি দুনিয়া, অন্যদিকে সোভিয়েত— বরফাবৃত ধূসর মহাদেশের বুকে কোনো রত্নখনি লুকিয়ে রয়েছে কিনা— তা নিয়েই ইঁদুরদৌড় চলছে দু’পক্ষের মধ্যে। সে-সময় ফ্রান্সের প্রতিনিধি হিসাবেই আন্টার্কটিকায় হাজির হয়েছিলেন ক্লদ। ছিলেন প্রায় একটানা ২ বছর। সে-সময় যা ছিল এক আশ্চর্য নজির।
একবার নয়, জীবদ্দশায় সবমিলিয়ে ২২ বার আন্টার্কটিকায় অভিযান করেছেন ফরাসি বিজ্ঞানী। আন্টার্কটিকার গঠন এবং ভূমিরূপ নিয়ে একাধিক গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশেষ হল, ক্লদই প্রথম প্রমাণ করে দেখান, বিশ্বের জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে আদতে দায়ী মানব সভ্যতা। কিন্তু কীভাবে প্রমাণ করেছিলেন তিনি?
ফিরে যাওয়া যাক শুরুর সেই গল্পে। হুইস্কির গ্লাসে বুদবুদ দেখেই ক্লদ বুঝেছিলেন, আন্টার্কটিকায় জমে থাকা বরফের চাদরের মধ্যে আসলে জমে রয়েছে লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। বাতাসের জলকণার সঙ্গে সে-সময়ের বায়ুও তুষারে আবদ্ধ হয়েছে। আন্টার্কটিকার বরফের চাদর খনন করে যত গভীরে যাওয়া যাবে, সেখান থেকে সন্ধান মিলবে তত প্রাচীন বায়ুমণ্ডলের নমুনা।
দেড় লক্ষ বছর প্রাচীন নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের বায়ুমণ্ডলের নমুনা সংগ্রহ করেন তিনি। তারপর সময়ের ভিত্তিতে সেই নমুনার বিশ্লেষণে দেখান, শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই অস্বাভাবিকভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বায়ুমণ্ডলে। আর সেটাই পৃথিবীর গড় উষ্ণতাবৃদ্ধি বা উষ্ণায়নের কারণ। ক্লদের এই গবেষণা সে-সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। এমনকি তারপরই একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয়েছিল পরিবেশ ও জলবায়ুচুক্তি।
সবমিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্লদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই। গবেষণা থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজেই একটি অলাভজনক সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন কিংবদন্তি ফরাসি গবেষক। ‘ল্যাবরেটরি দে গ্লেসিওলজি’-খ্যাত এই সংস্থা আন্টার্কটিকা নিয়ে গবেষণা তো বটেই, মানুষের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সাধারণকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমানে। এই বিপুল কর্মকাণ্ডের জন্য পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা। যার মধ্যে রয়েছে বাওয়ার প্রাইজ, ব্লু প্ল্যানেট অ্যাওয়ার্ড, সিএনআরএস গোল্ড মেডেলের মতো সম্মান। বলাই বাহুল্য, এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে স্বর হারাল ধীরে ধীরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপক্ষে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন…
Powered by Froala Editor