সংবাদমাধ্যম, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। যে কোনো দেশে, সমাজ ব্যবস্থায় এর ভূমিকা কতটা সেটা আর বলে দিতে হয় না। কিন্তু যে জায়গায় সংবাদমাধ্যমকে দেখা উচিত, সেখানে কি দেখতে পারছি আমরা? সাম্প্রতিক নানা সময় এই বিতর্কটাই উঠেছে ভারতে। এখনও উঠছে। মিডিয়া বা প্রেস যদি সরকারের হাতে থাকে, তাহলে তো একটা গোটা শক্তিকে নিজের কুক্ষিগত করা। সত্যি কথাকে চেপে রাখা। কিন্তু শুধু আজকেই কি এরকমটা হচ্ছে? ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারের রোষ, প্রভাব বিস্তারের নানা ঘটনা কি আধুনিক সময়ের ক্ষমতার দান? ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। বিশ্বের নানা জায়গায়, নানা সময় সাংবাদিকরা রক্তাক্ত হয়েছেন, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে তো বটেই! ব্রিটিশ শাসনের দিকে তাকালে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ছড়িয়ে আছে নানা সময়…
উনবিংশ শতক। পলাশির যুদ্ধও হয়ে গেছে বহু আগে, ইংরেজরাও যাকে বলে কোমর বেঁধে জাঁকিয়ে বসেছে বাংলায়। তখনও সিপাহি বিদ্রোহ হয়নি। তবুও সাহেব রাজাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তো উঠছিলই। আঞ্চলিকভাবে নানা ভাবে শুরু হয়েছে বেশ কিছু সংগ্রাম। এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে সংবাদপত্র। বাংলা তখন অবিভক্ত, কলকাতা ব্রিটিশদের রাজধানী। সাধের শহরও বটে। কিন্তু তা হলে কি হবে, আওয়াজ যে বেড়ে চলেছে এখানে! কলকাতার সংবাদপত্রগুলোও কথায় কথায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে। কি বাংলা, কি ইংরাজি— দুটি ভাষাতেই এমন কিছু লেখা বের হতে লাগল, যা তখনকার বড়লাট লর্ড হেস্টিংসের মতে মনে হল সরকার-বিরোধী, নিয়ম বিরোধী। চেনা চেনা লাগছে শব্দদুটো?
যাই হোক, এরপর প্রশাসনের তরফ থেকে ‘সবক শেখানো’র বন্দোবস্ত শুরু হতে লাগল। ইতিমধ্যে ১৮২২ সালের অক্টোবর মাসে একটি দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন উইলিয়াম বাটারওয়ার্থ বেলী। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল দেশীয় ভাষার সংবাদমাধ্যমগুলো। তাঁর মতে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সেখানে অবাধ আলোচনা সরকার এবং রাষ্ট্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা তাঁর ব্যক্তিগত বক্তব্য মনে হলেও, প্রকারান্তরে ব্রিটিশ সরকারেরও একই মনোভাব। কারণ আমরা দেখব ওই অক্টোবরেই লর্ড হেস্টিংস এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য সরাসরি ইংল্যান্ডে যোগাযোগ করলেন। নিজেও সেখানে গেলেন; এবং স্বীকৃতিও মিলল। পরে ১৮২৩ সালের ৪ মার্চ তিনি একটি নতুন প্রেস আইন জারি করেন।
এই আইনের ফলে, এরপর থেকে সমস্ত সংবাদপত্রকে পুলিশ এবং সরকারের প্রধান সেক্রেটারির কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। তা না হলে কোনো সংবাদপত্র বের হবে না। এই নিয়মের প্যাঁচে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় রাজা রামমোহন রায়ের ফার্সি পত্রিকা ‘মীরাৎ-উল-আখবার’। এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই কাজটি করতে হয় রামমোহনকে। এবং পরে এর প্রবল সমালোচনাও করেন।
এরপর আরেকটা ঘটনার দিকে যাওয়া যাক। এর সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত। সিপাহী বিদ্রোহের পর নানা জায়গায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বাড়তে থাকে। বিপ্লবী কাজকর্মও গোপনে চলতে থাকে। সংবাদপত্রগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে আবার। তীব্র ভাষায় সরকারকে আক্রমণ করা হয় এসব জায়গায়। ফলত, আবারও ‘ছড়ি ঘোরানোর’ রাস্তা নেয় ব্রিটিশ প্রশাসন। এবার আরও কঠোর আইন আনতে হবে। সেই সূত্রেই ১৮৭৮ সালের ১৪ মার্চ, লর্ড লিটনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী পাশ করা হল একটি নতুন আইন। ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’।
ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত এই আইন দেশীয় সংবাদপত্রগুলোর গলা টিপে ধরল। ব্রিটিশদের মতে, এই সংবাদপত্রগুলোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে সরকারকে ছোটো করা। সরকারের কাজকে আক্রমণ করা। এই কথাগুলোও খুব চেনা আমাদের কাছে! যাই হোক, এই আইনের প্রভাবে রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায় সোমপ্রকাশ, সুলভ সমাচারের মতো প্রচলিত পত্রিকাগুলি। তখনকার বিখ্যাত বাংলা সংবাদপত্র ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ বদলে গেল ইংরাজিতে। অনেক সম্পাদককে গ্রেফতার করা হল। সমস্ত দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হল। পরে অবশ্য লর্ড রিপন ১৮৮১ সালে এই আইনটি রদ করে দেন।
ইতিহাস হোক, বা বর্তমান— গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বারবার আক্রান্ত হয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। সত্যি কথা বলার, প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছে। এখন কি সেই ছবিটা টিকে আছে? প্রশ্ন রইল সবার কাছে।
তথ্য ঋণ - বাংলা সাময়িক-পত্র, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor