কিছু বছর আগেও অনেক বাঙালির পায়েই জুতোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবে আজকাল জামাকাপড়ের মতো এই জুতোর বাহারও আজ নানারকম। পা ঢাকা শ্যু হোক বা স্যান্ডেল অথবা কিটো, জুতো বললেই বাঙালির প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকবে শ্রীলেদার্স। কিন্তু এই জুতোর মধ্যেই যে লুকিয়ে আছে বহু প্রাচীন ইতিহাস, তার খবর আর কতজন রাখেন?
এই ইতিহাস খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। জায়গাটা চট্টগ্রামের ব্রিটিশ অস্ত্রাগার। সেদিন মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র ৬৫ জনের একটি বাহিনী দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নে মশগুল। অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর শুরু হল আরেক লড়াই। যে অস্থায়ী সামরিক সরকার তৈরি করলেন মাস্টারদা, তাকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। বিপ্লবী দল দুর্গম জঙ্গল পেরিয়ে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হল চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে। পথে জালালাবাদ পাহাড়ে শুরু হল যুদ্ধ। এইসব কাহিনি মোটামুটি আমাদের সকলের জানা।
তবে ভাবছেন নিশ্চই, জুতোর কথা বলতে গিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল বা জালালাবাদের যুদ্ধের কাহিনি আসছে কেন? কারণ সেদিনের সেই ৬৫ জনের দলের মধ্যেই ছিলেন ২১ বছর বয়সের সুরেশ দে। জালালাবাদের যুদ্ধে পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন তিনি। আরেক সহযোদ্ধা তাঁকে পাহাড় থেকে নামিয়ে এনে গ্রামে রেখে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়লেন সুরেশ। পুলিশ চেয়েছিল বাকি বিপ্লবীদের সন্ধান। কিন্তু সুরেশ নিশ্চুপ। ফলে বাড়তে থাকে অত্যাচারের মাত্রা। তবে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেলেও গৃহবন্দি হয়ে থাকেন সুরেশ দে। এমনকি কিরণময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহের দিনও বাড়ি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ।
যাই হোক, এসবই গৌরচন্দ্রিকা। শ্রীলেদার্সের কাজ শুরু হল স্বাধীনতার পরে। দেশভাগের পর সুরেশ দে চলে এলেন এপারে। ঠাঁই নিলেন জামশেদপুরে শহরে। কিন্তু স্বাধীন দেশে তিনি করবেন কী? গোলামির চাকরি তাঁর পোষাবে না। তিনি ঠিক করলেন ব্যবসা করবেন। জুতোর ব্যবসা। সময়টা এমন যে ভারতীয়দের মধ্যে তখনও জুতো পড়ার তেমন রেওয়াজ নেই। সামর্থ্যও নেই। সুরেশ দে ঠিক করলেন তিনি প্রত্যেকের সামর্থ্যের মধ্যে জুতো তৈরি করবেন। আর এই পরিকল্পনা থেকেই ১৯৫২ সালে জামশেদপুরে শুরু হল শ্রীলেদার্সের পথচলা। প্রথমে ছিল একটি জুতোর দোকান। তবে স্বল্প দামে চামড়ার জুতো জনপ্রিয় হতে বেশি সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে ব্যবসাও বাড়তে থাকে। একটি দোকান থেকে দেশের নানা প্রান্তে তৈরি হল আউটলেট। তবে এসবই মূলত সুরেশ দে-র ছেলেদের হাত ধরে।
১৯৯০ সালের ২১ মে প্রয়াত হলেন সুরেশ দে। তারপর ব্যবসার দায়িত্ব নিলেন তিন ছেলে শেখর, সত্যব্রত এবং আশিস। শেখর এবং আশিস থেকে গেলেন জামশেদপুরে। শুধু সত্যব্রত আগেই কলকাতা চলে এসেছিলেন। তাঁর হাতেই ১৯৮৫ সালে লিন্ডসে স্ট্রিটে তৈরি হল ৭০০ বর্গফুটের শোরুম। বাঙালির সঙ্গে শ্রীলেদার্সের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সেই থেকেই। আজ তার প্রতিপত্তিও অনেকটাই বেড়েছে। ভারতের বাইরে জার্মানি, গ্রিস এবং কুয়েতেও ব্যবসা শুরু করেছে শ্রীলেদার্স। এদেশেই কোম্পানির শোরুম আছে অন্তত ৩০টি। কলকাতার পাশাপাশি দিল্লির ব্যবসার দেখভাল করেন সত্যব্রত দের পুত্র সুমন্ত দে। আর সব মিলিয়ে বছরে টার্নওভার ১০০ কোটির উপরে।
কোম্পানির ট্যাগলাইনে বলা হয়েছে 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস, রাইট প্রাইস'। তবে সেই বিশ্বমানের নিচেই লুকিয়ে আছে খাঁটি স্বদেশি উদ্যোগের ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক রক্তও মিশে আছে তাতে। আর আছে অসংখ্য মানুষের আবেগ আর নস্টালজিয়া। বানিজ্যিকভাবে শ্রীলেদার্সকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলেও, এমন একটা ঐতিহ্যের জন্ম সব কোম্পানি দিতে পারবে না।
আরও পড়ুন
বিপ্লবে জড়িয়েও ফাঁকি দেননি পড়াশোনায়, প্রীতিলতার পরীক্ষার খবরে মুগ্ধ মাস্টারদা
Powered by Froala Editor