কেবল কিংসফোর্ড নয়, পূর্ববঙ্গের ছোটলাটকেও হত্যার চেষ্টা করেছিলেন প্রফুল্ল চাকী

১৯০৭ সাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার দিকে দিকে। কলকাতা তো বটেই, অন্যান্য জায়গাতেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। এমন পরিস্থিতিতেই রংপুরে বেড়ে উঠছিল একটি কিশোর। স্কুলে পড়ে সে; কিন্তু স্বাধীনতার চেতনা তখনই ঢুকে গেছে তার মধ্যে। ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করতেই হবে। কুস্তি আখড়ায় অস্ত্রশিক্ষা করে, গুপ্ত সমিতি গঠন করে, বই পড়ে নিজেদের ভেতরে ভেতরে তৈরি করাই পন্থা। কিন্তু ছেলেটি আরও কিছু করার জন্য মুখিয়ে ছিল। পড়াশোনা শেষ করার পর আর থাকলেন না রংপুরে। সোজা চলে এলেন কলকাতায়। এই ছেলে নাম কী তোর? উত্তর এল- ‘প্রফুল্ল চাকী’… 

রংপুরে থাকতে থাকতেই নিজের বুক চেরা রক্ত দিয়ে বিপ্লবের শপথ লিখেছিল প্রফুল্ল। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্রয়োজনে দেশমাতার জন্য প্রাণও বিসর্জন করবেন। সেই শপথবাক্যকে পাথেয় করে তিনি হাজির হলেন মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে। বাড়িটি আদতে ঘোষেদের; আর সেই পরিবারেরই দুই ছেলে সমস্ত কর্মকাণ্ডের হোতা। প্রফুল্ল চাকীর মুখোমুখি হলেন অরবিন্দ ঘোষ। বারীন ঘোষ অবশ্য রংপুরেই দেখেছিলেন এই তরুণটিকে। প্রফুল্লের মতো আরও তরুণ বিপ্লবীদের আস্তানা তখন মুরারিপুকুরের এই বাগানবাড়িটি। অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বোমা বাঁধা, পিস্তল চালানো— সবকিছু চলতে লাগল এখানে। প্রফুল্লরাও তৈরি হতে লাগলেন আগামী দিনগুলোর জন্য। 

পূর্ববঙ্গের ছোটলাট স্যার র্যা মফিল্ড ফুলার ছিলেন বিপ্লবীদের অন্যতম নিশানা। এইরকম ইংরেজ কর্তাদের ওপর আঘাত হেনেই ভারতীয়দের আসল শক্তি দেখাতে হবে। আপোষ করে আর নয়; এবারে পন্থা হোক অস্ত্রের বদলে অস্ত্র। কিন্তু বিপ্লবীদের ভাগ্য কিছুতেই সহায় হচ্ছিল না। ১৯০৬ সালে বেশ কয়েকবার র্যা মফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হাতে ফিরতে হয়েছে। ১৯০৭-এ আবারও উদ্যোগ নিলেন বারীন ঘোষ। কিন্তু হত্যার আগে একটু টাকাপত্র সংগ্রহ করতে হবে। আর সেই সময় বিপ্লবীদের টাকা সংগ্রহের উপায় বলতে ছিল দুটি— ব্যক্তিগত পুঁজি, অথবা ডাকাতি। ‘স্বদেশী ডাকাত’ নামই হয়ে গিয়েছিল বিপ্লবীদের। 

অরবিন্দ ও বারীন ঘোষ ঠিক করলেন, রংপুরের একটি জমিদার বাড়িতে ডাকাতি করা হবে। কলকাতা থেকে পাঁচজনের একটি দল গেল সেখানে; আর স্থানীয় আরও দুই বিপ্লবীকে সামিল করা হল। এই পুরো কাজটির নেতৃত্বে থাকলেন প্রফুল্ল চাকী। ক্রমশ রাত ঘনিয়ে আসছে। দলের সবাইকে নিয়ে প্রফুল্লও তৈরি। এমন সময় খবর এল, জমিদারবাড়ির ভেতর বসে রয়েছে পুলিশ। কী করে যেন খবর পৌঁছে গেছে ওখানে। ব্যর্থ হলেন তাঁরা। 

কয়েকদিন পর আরও একটি সুযোগ এল। ধুবড়ি থেকে বিশেষ ট্রেনে করে ফুলার সাহেব রংপুরে আসবেন। যাতায়াতের পথে বসে থাকবেন বিপ্লবীরা। রেললাইনে বোমা রেখে দেওয়া হবে। ট্রেন যখনই যাবে, বোমা ফাটবে। এবারও দায়িত্বে প্রফুল্ল চাকী; তবে এবার আরেকটু বেশি। রংপুরে ছোটলাটের ট্রেন ঢোকার আগে যদি বোমাটি না ফাটে, তাহলে বিপ্লবী পরেশ মৌলিককে সঙ্গে নিয়ে ট্রেন থামাবেন প্রফুল্ল। তাঁর কাছে থাকবে একটি পিস্তল। সোজা ট্রেনে উঠে ফুলার সাহেবকে গুলি করে হত্যা করতে হবে। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হল সামগ্রিক পরিকল্পনা। বোমাও ফাটেনি, গুলিও চলেনি। র্যামফিল্ড ফুলার অন্য পথে রংপুর পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই খবর বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছয়নি… 

তবে চেষ্টা থামালে তো হবে না। খবর এল, নৈহাটি রেল স্টেশন থেকে বিশেষ ট্রেনে উঠবেন ফুলার সাহেব। এবার আর দল নয়; একা প্রফুল্ল চাকীকে দেওয়া হল দায়িত্ব। নির্ধারিত দিনে নৈহাটি স্টেশন লোকে লোকারণ্য। বেশি দেখা যাচ্ছে পুলিশদের। আর স্টেশনে অপেক্ষা করছেন প্রফুল্ল। ব্যাগের ভেতর তাজা বোমা, পিস্তলও রয়েছে। সুযোগ বুঝে ছোটলাট এলে ছোঁড়া হবে। সব দিক সামলেও প্রফুল্ল চাকীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ট্রেনের আশেপাশে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ধাক্কা। হাজির হয়েছে পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্টেশন থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁকে। আর ফুলার সাহেব ততক্ষণে ট্রেনে উঠে পাড়ি দিয়েছেন গন্তব্যে… 

আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখে ইংল্যান্ডের পুরস্কার জয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনিতা

সাহেবের প্রাণ বড়ো কড়া, তা মানতেই হবে। বারবার বেঁচে যাচ্ছেন। এরপরও বিভিন্ন ডাকাতি ও বিপ্লবী পরিকল্পনায় যুক্ত হয়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী। বারীন ঘোষ ভরসা করতেন এই তরুণের ওপর। এমন সময় ঘটল এক ঘটনা। সুশীল সেন নামের এক কিশোর ঘুষি মেরে একজন পুলিশের নাক ফাটিয়ে দেয়। তার শাস্তি হিসেবে বেত দিয়ে পনেরো ঘা মারার হুকুম দেন বিচারক কিংসফোর্ড। ব্রিটিশদের এমন দম্ভ! এমন নারকীয়তা! এই কিংসফোর্ডকে বাঁচানো ঠিক হবে না। রাজা সুবোধ মল্লিক, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ-সহ শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীরা গোপন বৈঠকে বসলেন। কীভাবে মারা হবে, কে-ই বা যাবে এইসব আর কি। খেয়াল করলেন না, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে প্রফুল্ল। চোখ স্থির, চোয়াল শক্ত; শরীর যেন চাবুকের মতো হয়ে গেছে। সবাইকে থামিয়ে বলে উঠলেন প্রফুল্ল চাকী— ‘আমি প্রস্তুত।’ পরবর্তীতে পাড়ি দিলেন মজঃফরপুরের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী কিশোর ক্ষুদিরাম বসু। বাকিটা, ইতিহাস… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘প্রফুল্ল চাকী’, সব বাংলায়
২) ‘প্রফুল্ল চাকী: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় এক বীর’, আবু রায়হান খান, রোর বাংলা n                                                   

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শহিদ হওয়ার আগেই ইংরেজ জেলাশাসককে হত্যা, রক্তাক্ত মেদিনীপুরের ফুটবল মাঠ

More From Author See More

Latest News See More