১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট। মুজাফফরপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি হয় ক্ষুদিরাম বসুর। সেই আগস্ট মাসই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও উজ্জ্বল পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের মাধ্যমে। কিন্তু সেই মাসেই বিতর্ক তুঙ্গে উঠল স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হওয়া ক্ষুদিরাম বসুকে অবমাননার অভিযোগে।
অভিযোগের কারণ: একটি জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে পুলিশ স্টেশনের একটি দৃশ্যে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ কুখ্যাত অপরাধীদের দেখা গিয়েছে ক্ষুদিরাম বসুর ছবি। কীভাবে এই ছবি সেখানে গেল, কেন ওই ওয়েব সিরিজ কিংবা চ্যানেলের সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষের সকলের নজর এড়িয়ে দিব্যি টেলিকাস্টও হয়ে গেল সেই সিরিজ— প্রশ্ন উঠেছে সেসব নিয়েও।
সাম্প্রতিক অতীতে বারংবারই বাঙালিদের প্রতি জাতিবিদ্বেষের অভিযোগ উঠেছে হিন্দি বলয়ের দিক থেকে। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে কাজের জায়গা, সব জায়গাতেই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে হিন্দি ভাষা। এমনকি সদ্য বলি অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর আইনের তোয়াক্কা না করেই তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একের পর এক বাঙালি বিদ্বেষী মিম, যেগুলিকে কুরুচিকর বললেও কম বলা হয়। এই প্রেক্ষিতেই ওটিটি চ্যানেল জি ফাইভে সম্প্রচারিত এই ওয়েব সিরিজের বিতর্ক নয় দিশা দিল এই বিতর্ককে।
তবে এই তো প্রথম বার নয়। এর আগেও পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের পাঠ্য বইতে ক্ষুদিরাম বসুকে ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দেওয়া হয়েছিল। তা নিয়ে শুরু হয়েছিল বিতর্কও। চাপের মুখে ভুল স্বীকার করে নিয়ে সেটি সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এই ঘটনার পরে আরো একবার স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের মুহূর্তেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের এই ওয়েব সিরিজের দৃশ্যে মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীদের তালিকায় ক্ষুদিরাম বসুর ছবি সেই বিতর্ক উসকে দিল আবারও।
আরও পড়ুন
অপরাধীদের তালিকায় শহীদ ক্ষুদিরাম বসু! হিন্দি ওয়েব সিরিজে অবমাননা বাঙালি বিপ্লবীকে?
সব থেকে আশ্চর্যের কথা, এই ওয়েব সিরিজের পরিচালক কেন ঘোষের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অভিনেত্রী বিদিতা বাগ, সন্দীপা ধর কিংবা লেখকদের মধ্যে পুশন মুখার্জী, স্মিতা মুখার্জীর মতো বাঙালিরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেট অথবা আর্ট ডিজাইন ডিম থেকে শুরু করে এমনকি ছবির এডিট বা অন্যান্য পোস্ট প্রোডাকশনের কাজের সময় এই ভুল কারো চোখে ধরা পড়ল না, সেটাই আশ্চর্য করেছে সকলকে। নাকি ধরা পড়লেও জনপ্রিয় শব্দবন্ধ ‘ছোট্ট ভুল’ মনে করে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়াই সমীচিন মনে করেছেন নির্মাতারা? প্রশ্নগুলো কিন্তু থাকছেই।
স্বাভাবিকভাবেই সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা শুরু হলেও একটি বিশেষ চলন দেখা গিয়েছে তার মধ্যেও। জি ফাইভের তরফে যে ক্ষমাবার্তা পাঠানো হয়েছে, তাতে পরিষ্কার লেখা আছে যে অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য তারা দুঃখিত এবং কোনও জাতি বা কমিউনিটিকে ছোট করা বা আঘাত দেওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। অবিলম্বে সেই দৃশ্যে ক্ষুদিরাম বসুর ছবি ‘ব্লারড্’ অর্থাৎ ঝাপসা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় চ্যানেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠছে যে, ক্ষুদিরাম কি কেবলই বাংলা বা বাঙালির স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন? বাংলা ভাষায় লেখা হলেও গানেও বলা ছিল, ‘হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, ক্ষুদিরাম বসুর জায়গায় যদি সেখানে আন্নাদুরাই, এম জি রামচন্দ্রন কিংবা এন টি রামারাও-এর ছবি থাকত তবে কি দক্ষিণ ভারতের মানুষেরা চুপ করে বসে থাকতেন? বিক্ষোভ, প্রতিবাদ মিছিল নেমেছে রাস্তায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে জি ফাইভ এবং এই ওয়েব সিরিজ বয়কট করার ডাক।
আরও পড়ুন
মৃত্যুভয় দূরের কথা; ফাঁসির পূর্বমুহূর্তে জল্লাদকে কী জিজ্ঞেস করেছিলেন ক্ষুদিরাম?
মাত্র ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন বয়সে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের ধ্বজাধারীকে শেষ করতে গিয়ে ভুল করে বোমা মেরে বসেন অপর একটি ফিটন গাড়িতে। কিন্তু ক্ষুদিরাম বসু ‘খুনি সন্ত্রাসবাদী’ নাকি ‘শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামী’ সেই আলোচনার বাইরেও থেকে যায় একটা আত্মত্যাগের গল্প। যে গল্পে একটা সদ্য যুবক বাঙালি ছেলে স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন দেশে নিঃশ্বাস ফেলার। সেই রকম একটি চরিত্র ক্ষুদিরাম বোসকে এহেন অপমান করার পরেও শুধুমাত্র ‘ব্লারড্’ করে তার প্রভাব যে ঝাপসা করে দেওয়া যায় না মন থেকে, সেই কথা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল না কি? নাকি আজও নতুন করে ইতিহাস বদলে ফেলতে চাওয়া আগ্রাসী হিন্দি বলয়ের কাছে এগুলো জাতিগত বিভেদ তৈরি করার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চাল কিনা, সেই নিয়েও খানিক সন্দেহ থেকেই যায় মনে। কারণ ‘রেভোলিউশনারি টেররিস্ট মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামের আর্টিকেলে এখনও ইন্টারনেট ঘাটলেই পাওয়া যায় লালা লাজপত রায়, বিনায়ক সাভারকারের সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসুর ছবিও। সুতরাং এই অসুখের বীজ অনেক গভীরে, জাতীয় ঐক্যের হিসেবে সমস্যা তৈরি করার জন্য যা যথেষ্ট। দেশের স্বাধীনতায় ক্ষুদিরাম বসুর অবদান এবং আত্মত্যাগ মাথায় রেখেই যে বিষয়ে আশু সাবধান হওয়া প্রয়োজন দেশবাসীর; এবং অবশ্যই, দায় এড়াতে না পারা শিল্পেরও।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor