রক্তবিন্দু দিয়ে উদ্ধার হবে ‘স্বাধীনতার ধন’—এই বার্তায় শুরু ‘প্রথম’ সর্বজনীন দুর্গোৎসবের

কলকাতার প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপুজো কাদের? সিমলার ব্যায়াম সমিতির পুজো নাকি বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবের? দুটো পুজোর সূত্রপাতই কাছাকাছি সময়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জড়িয়ে ছিলেন উভয়ের সঙ্গেই। উদ্দেশ্য এক হলেও, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল না দুপক্ষের মধ্যে। যদিও বাংলায় ‘বারোয়ারি’ পুজোর সূত্রপাত তার অনেক আগে থেকেই। বলা হয়, হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১৭৬১ সালে বারো জন ‘ইয়ার’ বা বন্ধু মিলে শুরু করেন দুর্গাপুজো। বাড়ির পুজোকে সবার জন্য বাইরে নিয়ে আসার চল সেই থেকে। অবশ্য ১৮২০ সালের ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকা জানাচ্ছে যে, তিরিশ বছর আগে শুরু হয় এই পুজো। সেক্ষেত্রে সময়কাল দাঁড়ায় ১৭৯০। ফলে সেই নিয়েই তর্ক-বিতর্ক আছে একপ্রস্ত।

সে ইতিহাস চর্চিত কম-বেশি। কিন্তু এই গল্পটা ১৯২৬ সালের। যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী অতীন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে সিমলার ব্যায়াম সমিতিতে শুরু হয় ‘সার্বজনীন’ দুর্গাপুজো। শব্দটার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এখান থেকেই। সে বছরের ২ এপ্রিল ‘বীরাষ্টমী’ উৎসব উপলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যায়াম সমিতি। কেন এই উদ্যোগ নিয়ে এলেন অতীন্দ্রনাথ? তাঁর নিজের বাড়িতেও দুর্গোৎসব পালিত হত মহাসমারোহে। নিমন্ত্রিত ছাড়া কারোর অধিকার ছিল না বাড়ির পুজোয় প্রবেশ করার। সেই বিধিনিষেধ ভাঙার জন্যই তিনি নিয়ে আসেন সার্বজনীন পুজোর পরিকল্পনা। যাতে জাত-ধর্মের পরোয়া না করে, আর্থিক বৈষম্যকে অস্বীকার করে সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হতে পারে শরতের আয়োজনে। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে আরেকটা গভীর কারণ। 

স্বাধীনতা সংগ্রাম তখন তুঙ্গে। বাংলার যুবক-যুবতী শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে ব্রিটিশ সিংহের বিরুদ্ধে। অসুরদলনী মা দুর্গা যেন হয়ে উঠলেন স্বাধীনতাকামী মানুষের স্পর্ধার মূর্তরূপ। প্রথম বছরের পুজোতে সেই চেতনাকে বাস্তব চেহারা দিল ব্যায়াম সমিতি। জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার প্রতিকৃতিকে দর্পের সঙ্গেই সকলের সামনে প্রতিষ্ঠা করল তারা। পলাশির যুদ্ধ থেকে সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত ভারতের মুক্তি আন্দোলনের অসংখ্যা ঘটনাকে তুলে ধরা হল পুতুল ও পোস্টারের মাধ্যমে। যার শিরোনামে থাকত বিভিন্ন উক্তি। যেমন, ‘রক্তাম্বুদি আজি করিয়া মন্থন তুলিয়া আনিব স্বাধীনতার ধন’, কিংবা ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’। আরেকটি মূর্তির উপরে পোস্টারে লেখা ছিল, ‘সময় হয়েছে নিকট এখন বাঁধন ছিঁড়তে হবে’। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ছিল বাঘা যতীনের লড়াই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, কোহিমার যুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা। ব্রিটিশ পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নিয়ে যেত স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র। 

কিন্তু টনক নড়তে দেরি হল না তাদের। বুঝতে পারল সার্বজনীন পুজো উদ্যোগের আসল উদ্দেশ্য। স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন যার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা। ‘অন্নকূট’ অনুষ্ঠানেও নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন তিনি। এছাড়াও শরৎচন্দ্র বসু, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিলেন ব্যায়াম সমিতির সঙ্গে। ১৯৩০ সালে নারায়ণচন্দ্র দে ও ভূপাল বসু বোমা মারেন অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের গাড়ি উদ্দেশ্য করে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন টেগার্ট। ধরা পড়ে গেলেন দুই বিপ্লবী। শুরু হল বিখ্যাত ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা। ঘটনাচক্রে নারায়ণচন্দ্র দে ছিলেন সিমলা ব্যায়াম সমিতির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। ফলে কোপ এসে পড়ল তাদের উপরেও। ১৯৩২ সালের ৭ অক্টোবর আদালত থেকে বেআইনি করে দেওয়া হয় সমিতিকে। ব্যায়ামের যাবতীয় সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় মূল দরজায়।

আরও পড়ুন
বাঙালির ‘মাই’ ও কিছু টিপ্পনী

তাতে কি বন্ধ থেকেছে দুর্গাপুজো? না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে দেখতে এসেছে ‘সার্বজনীন’ পুজো। ১৯৩৬ সালের খবর অনুযায়ী প্রত্যেক দিন তিন হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল এখানে। জাতপাত নির্বিশেষে অঞ্জলি দেওয়া হয় অষ্টমী তিথিতে। কয়েক বছর পরে এখানে একচালার বদলে শুরু হয় পাঁচচালার পুজো। সংশয় প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই, হয়েছিল সমালোচনাও। কিন্তু অতীন্দ্রনাথের পরিষ্কার উত্তর, “মার পূজার ধ্যানের কোথায় আটকাচ্ছে?” তারপর শিল্পী নিতাই পালকে ডেকে সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে তুলে ধরেন নতুন মাতৃপ্রতিমার শাস্ত্রীয় যুক্তি।

আরও পড়ুন
ঘরে ফিরলেন উমা, প্রবাসী মধুসূদনের চোখে ‘বারি-ধারা’

প্রায় একশো বছর হতে চলল সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর। ইতিহাসের পাতা ধরে সাক্ষী থেকেছে বহু ঘটনার। অতীন্দ্রনাথ বসুর আদর্শে যেভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ বুকে গ্রহণ করেছিল এই পুজো, তার উদাহরণ বিরলতম। উৎসব সবার, স্বাধীনতাও সবার। বিভেদের প্রাচীর অতিক্রম করে তাই সেদিন তারা ডাক দিয়েছিল, “আমরা এক জননীর সন্তান”।

চিত্রঋণ : সিমলা ব্যায়াম সমিতি

Powered by Froala Editor