নিজের তৈরি বাড়িই ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর দিকে

চারিদিকে ছোটো-ছোটো টিলা। মাটি এখানে রুক্ষ না হলেও, সবুজের পরিমাণ বড্ড কম। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে কিছু ঘাসের জঙ্গল। দূরবীন ছাড়া বড়ো গাছের দেখা পাওয়া মুশকিল। এমনকি পশু-পাখির সংখ্যাও বেশ কম এখানে। সেই নির্জন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঠের বাড়ি। প্রথম দর্শনে চমকদার মনে হলেও, ক্রমে চোখে পড়বে একের পর এক দুর্বলতা। আর যাই হোক, এখানে মানুষ থাকতে পারে না। কিন্তু বছরের পর বছর এখানেই ছিলেন একজন। তাঁর নাম ফ্রান্সিস লি স্মিথ (Francis Lee Smith)। তিনিই এই বাড়ির স্থপতি। আর এই বাড়িই হয়েছিল উঠেছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।

নিজের বাড়ি নিয়ে স্বপ্ন থাকে প্রায় প্রতিটি মানুষের। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় স্বপ্নের বাড়ি। তারপর শুরু ঘর গোছানোর পালা। আমেরিকার লি স্মিথও ব্যতিক্রমী নন। তবে তাঁর স্বপ্ন ছিল একটু অদ্ভুত। শহরে বা গ্রামে নয়, বাড়ি তৈরি হবে নির্জন উপত্যকার মধ্যে। কোডি (Cody) শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে ওয়াপিতি উপত্যকার (Wapiti Valley) মাঝে কিনে ফেললেন বেশ কিছুটা জমি। ইয়েলোস্টোন অভয়ারণ্য থেকে একেবারে কাছেগ। রাত-বিরেতে হিংস্র পশুদের ডাক শোনাও আশ্চর্য নয়। তাতে অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নন স্মিথ।

প্রযুক্তিবিদ্যায় ভালোই ধারণা ছিল তাঁর। নিজেই তৈরি করলেন বাড়ির নকশা। এর কিছুমাস আগেই আগুন লাগে সামনের র‍্যাটলস্নেকে পাহাড়ে। ভস্মীভূত হয়ে যায় অসংখ্য গাছপালা। সরকার থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের ডাক দেওয়া হয় পোড়া কাঠ সরিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য। সেই তালিকায় নাম দেন স্মিথও। সবচেয়ে বেশি কাঠ সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। তাঁর উৎসাহ দেখে অনেকে অবাক হলেও, ঘুণাক্ষরে টের পায়নি স্মিথের উদ্দেশ্য। সেই পোড়া কাঠই হয়ে উঠল তাঁর ‘স্মিথ ম্যানসন’-এর প্রধান উপাদান।

কিন্তু প্রযুক্তিবিদ্যার ধারণা আর বাড়ি তৈরি তো এক জিনিস নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে বারবার ব্যাহত হতে লাগল তাঁর পরিকল্পনা। যত বাধা আসে, তত যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠেন স্মিথ। একটা সময় যেন কাজ করতে লাগলেন ঘোরের মধ্যে। শয়নে-স্বপনে শুধুই বাড়ি তৈরির আজগুবি চিন্তা। অবশেষে বারো বছরের চেষ্টায় তৈরি হল সেই কাঠের বাড়ি। যদি সেটাকে আদৌ বাড়ি বলা যায় তো! ঢালু ছাদের তিন স্তরের বাড়িটি দূর থেকে দেখতে নিঃসন্দেহে অপূর্ব। কিন্তু তা কি সত্যিই বাসযোগ্য? কাঠের ফাঁক দিয়ে প্রবল পাহাড়ি হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে যায়। একটু জোরে পা চালালেই অনুভব করা যায় বাড়ির দুলুনি। 

আরও পড়ুন
লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হতেন এই ‘অভিশপ্ত’ বাড়ির বাসিন্দারা

তবু যতই হোক, নিজের বাড়ি বলে কথা। আটের দশকের শেষের দিকে পরিবারসহ এখানে এসে ওঠেন স্মিথ। প্রথম দিকে স্ত্রী-সন্তানরাও চেয়েছিল যতটা সম্ভব মানিয়ে নিতে। কিন্তু কতদিন? বাজার-হাট করার জন্য পাড়ি দিতে হয় কয়েক কিলোমিটার। আশেপাশের কথা বলার লোক নেই। সঙ্গে প্রবল শীত। একটা হিটার অবশ্য আছে ঘরে। তাতেই রান্না, আবার তাতেই ঘর গরম করার কাজ। কয়েকটা পোড়া কাঠের গুঁড়িকে বানানো হল খাবার টেবিল। গভীর রাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে পশু-পাখি। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল শোওয়ার জায়গা নিয়ে। বাড়ির বাইরের অংশে আলাদা করে একটা ছোটো ঘর তৈরি করা হল বাচ্চাদের জন্য। আর স্মিথ-দম্পতির ঘুমানোর ব্যবস্থা হল কাপড়ের ঝুলন্ত বিছানায়।

আরও পড়ুন
এক বাড়িতেই থাকে গোটা শহর! কোথায়?

এভাবে দু-এক বছর কাটানোর পর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল স্মিথের স্ত্রীর। তল্পিতল্পা গুছিয়ে পাড়ি দিলেন শহরের উদ্দেশ্যে। কদিন পরে এল ডিভোর্সের নোটিশ। তাতে কি নিজের ‘ভুল’ বুঝলেন লি স্মিথ? না। বরং আরো জোর কদমে শুরু করলেন বাড়ি সাজিয়ে তোলার কাজ। একাই রয়ে গেলেন সেই বাড়িতে। নয়ের দশকের শুরুতে একদিন বাড়ির কাজ করার সময় ব্যালকনি থেকে পড়ে যান তিনি। মারাত্মক আহত হলেও জনমানবহীন অঞ্চলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক কোথায়? সেখানেই মৃত্যু ঘটে স্মিথের। এমনকি তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় দু’দিন পরে।

তারপর থেকে সেভাবে একা পড়ে ছিল বাড়িটি। অবশেষে ২০১৮ সালে স্মিথের মেয়ে সানি লারসেন বিক্রি করে দেন বাড়িটি। তবে নতুন মালিক ভাঙেননি সেই বাড়ি। ওভাবেই আজও দাঁড়িয়ে আছে ‘স্মিথ ম্যানসন’। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More