শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিট। বাংলাদেশের সমস্ত জায়গায় আচমকাই একটা হেডলাইন ভেসে উঠল। যার সূত্রপাত ঢাকার অ্যাপলো হাসপাতাল। দীর্ঘ বহু বছরের নিজের শরীরের সঙ্গে লড়াইয়ের পর, অবশেষে হার মানলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ব্রেন টিউমারের মারণ থাবা বসেছিল, আর তাতেই মৃত্যু হল এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটির। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
কলকাতার এই প্রজন্ম ফজলে হাসান আবেদ নামটির সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যারা পরিচিত তাঁরা অবশ্যই স্মরণে রাখবেন তাঁর কথা। শুধু কি তাই? আজ গোটা পৃথিবী একডাকে চেনে তাঁর সংস্থা ‘ব্র্যাক’-কে। যেটা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সম্মানিত বেসরকারি এনজিও এটি। ব্র্যাক, আর স্যার ফজলে হাসান— এই দুটো নাম যেন সমার্থক হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি হয়ত ভেবেছেন সেই শুরুর সময়ের কথা। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা। যার মাটি থেকে জন্ম নিয়েছিল এই ‘ব্র্যাক’।
১৯৩৬ সালে বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচোঙ গ্রামে জন্ম নেন তিনি। সেখানেই তিনি পড়াশোনা শেষ করে চলে যান বিদেশে। প্রথমে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়া শুরু করলেও মন বসেনি। চলে এলেন ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টসে। দেশে যখন ফেরেন, তখন উত্তাল পরিস্থিতি। মুক্তির সংগ্রামে তখন জাগছে পূর্ব পাকিস্তানের মাটি। তৈরি হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা এবং বিপর্যস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ফজলে হাসান আবেদ শুরু করলেন একটি নতুন সংস্থা। বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্ট কমিটি, সংক্ষেপে ‘ব্র্যাক’। তখন অবশ্য ছোট একটি পরিসরে কাজ আরম্ভ হয়। পরের বছরেই ভোল বদলে যায় ব্র্যাকের। একটি বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এটি। ডাকনামটি এক থাকলেও, ভাল নামটি সামান্য একটু বদলে যায়। ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’।
সেই শুরু একটি যাত্রার। একটি ইতিহাসের। আস্তে আস্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা হওয়ার যাত্রাপথটি সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি তো ফজলে হাসান আবেদ, হার মানবেন কেন! শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী শিক্ষা, বাল্যবিবাহ রোধ-সহ আরও নানান কর্মসূচি তিনি করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে নারী ও শিশুদের উন্নতি সাধনে ফজলে হাসানের অবদানের কথা বোধহয় সবাই স্বীকার করবেন। আর সেইজন্যই পেয়েছেন একের পর এক সম্মান। ১৯৮০ সালে রামন ম্যাগসেসেই পুরস্কার, ২০১৪-তে লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল, ২০১১-তে ওয়াইজ প্রাইজ ফর এডুকেশন— পুরস্কারের সংখ্যা যে অসংখ্য। আজ তাঁর সংস্থা ব্র্যাক বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর ১১টি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ ফজলে হাসান আবেদ চিরতরে বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।