কোনো আগ্নেয়াস্ত্র না, আত্মরক্ষার সামগ্রী বলতে সামান্য একটা লাঠি। এইটুকু সম্বল নিয়েই গভীর রাতে ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক ভদ্রলোক। বয়স আন্দাজ ৩৫ বছর। এ-সব রাস্তা তাঁর মতোই চেনা। জানা কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে কোন বিপদ। কোথায় চলছে কোন অনৈতিক কাজ। একসময় তিনিও যে বিরাজ করতেন সেই অন্ধকার জগতে। হ্যাঁ, তিনিও ছিলেন চোরাপাচারকারী (Loggers)। জড়িত ছিলেন অবৈধ বৃক্ষনিধনের সঙ্গে। বর্তমানে তাঁর কাঁধেই রয়েছে অরণ্য (Forest) রক্ষার দায়িত্ব।
আসামের (Assam) চড়াইদেও জেলার চালা সংরক্ষিত অরণ্যের ছবিটা এমনই। এ জঙ্গলে রাতভোর যাঁরা টহল দেন, তাঁরা সকলেই একসময় ছিলেন অপরাধী। অরণ্যনিধনের জন্য কেউ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পুলিশের হাতে, কারোর বিরুদ্ধে ছিল শিকারের অভিযোগ।
২০১৮ সালে পরিবেশ এবং অরণ্যের ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে আসামের সংরক্ষণ আন্দোলন শুরু করেন পরিবেশবিদ মানস শ্যাম। তাঁর উদ্যোগে চালায় শুরু হয়েছিল বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিও। তাতে রাতারাতি পরিবেশের হাল বদলে না গেলেও, বদলায় বহু মানুষের মানসিকতা। চোরাশিকার, অরণ্যনিধন ছেড়ে 'চালা সংরক্ষণ সমিতি'-তে যোগ দেন বেশ কিছু মানুষ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। জীবিকা বদলের জন্য বিকল্পেরও তো প্রয়োজন পড়ে।
'রত্নাকর'-দের বাল্মীকি হওয়ার সেই সুযোগটা এনে দিয়েছিল আসামের চালা সংরক্ষিত অরণ্যের বনদপ্তর। খাতায়-কলমে গোটা অরণ্যটির দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র ২ জন বনকর্মী ও একজন আধিকারিক। তাঁদের পক্ষে এত বড়ো অরণ্যের অপরাধ রোখা প্রায় অসম্ভব। এই অভাব পূরণ করতেই স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে গ্রামের প্রাক্তন অপরাধীদের সুযোগ করে দেন তাঁরা। বর্তমানে তাঁরাই হয়ে উঠেছেন এই অরণ্যের রক্ষাকর্তা।
আন্তর্জাতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২১ সালে আসামে অস্তিত্ব হারিয়েছে সব মিলিয়ে ১৮৪ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য। তবে চালার ছবি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে অরণ্যের পরিমাণ কমেনি। বরং, বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। নেপথ্যে, চালার প্রায় ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক। বননিধন আটকানোর পাশাপাশি যাঁরা সমানভাবেই লড়াই করছেন প্রকৃতির হাল ফেরাতে। চালিয়ে যাচ্ছেন দুর্লভ অর্কিড সংরক্ষণ থেকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।
চালা অরণ্যের এই নীতি মডেল হয়ে উঠতে পারে গোটা দেশের ক্ষেত্রেই। কর্মসংস্থানই কমিয়ে আনতে পারে অপরাধের মাত্রা, তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ আসামের এই অরণ্য...
Powered by Froala Editor