মহামেডানের হয়ে ময়দান কাঁপালেন ‘ফুটবলার’ সৌরভ, নাস্তানাবুদ ইস্টবেঙ্গলও

কলকাতায় শীত বলতে জানুয়ারির কটা দিন। তাও উত্তর ভারতের হাড়কাঁপানি শীত এখানে দেখা যায় না। নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করে শহরের কটা দিন। মাস কয়েক আগেই তৃতীয় আইপিএল শেষ হয়েছে এবং একরকম ধরেই নেওয়া যায় যে কলকাতার মহারাজ, নাইট রাইডার্স-এর মার্কি প্লেয়ার সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজির। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন তো সেই ২০০৮-এ, রঞ্জিতে আগের সিজনেই বাংলাকে অবনমন থেকে বাঁচিয়ে খেলা থামিয়েছেন। তাহলে কি আর কলকাতা সৌরভকে মাঠে বল বা ব্যাট নিয়ে দেখবে না?

কিন্তু বারবার যিনি সমালোচকদের মুখের উপর জবাব দিয়ে ফিরে এসেছেন, সেই ২০১০-এর নভেম্বরের  দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়ন্ত বিকালে আবার একবার ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড পরে নামলেন। কিন্তু এ কোন পোশাক? কোন মাঠ? সাদা ট্রাউজার ও টিশার্ট বা ব্লিড ব্লুয়ের পাজামা পোশাকের জায়গা নিয়েছে সাদা কালো জার্সি এবং সাদা শর্টস, দুপায়ের কালো মোজায় শিন-বোনের উপর দুটো সাদা দাগ আর পায়ে কালো স্টাডসের বুক। বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের কৃত্রিম ঘাসের বুকে নিভিয়া বল নিয়ে সেন্টার লাইনের কাছে দাঁড়িয়ে আধুনিক বাংলার মেগাস্টার, ক্রিকেটের কিংবদন্তি সৌরভ গাঙ্গুলি। সঙ্গে নাইজিরিয় ক্রিস্টোফার। 

এ ব্যাপারটা বুঝতে ফিরে যেতে হয় প্রায় ২৪ বছর আগের মল্লিকবাজার পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের স্কুলটায়। সকলে যেটাকে সেন্ট জেভিয়ার্স বলে জানে। সদ্য মেক্সিকোর বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে, আর বিকেল তিনটে বাজতে না বাজতেই ছেলেপুলেরা নেমে পড়ছে সাদা কালো বল পায়ে। এর মধ্যে সেই ছেলেটাও রয়েছে, বাবা, দাদা যদিও ক্রিকেটে। বাবা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের কর্তাব্যক্তি আর দাদা তো বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হিসাবে যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, অচিরেই বাংলার হয়ে খেলবেন। অথচ লম্বা রোগা মতো ছেলেটি হাতের থেকে বল পায়েই বেশি স্বচ্ছন্দ। তবে প্রিয় মারাদোনার মতো বাঁ নয় ডান পাটাই চলে, স্কুলের ফুটবল দলে সাবজুনিয়র স্কুল লেভেলে ফরওয়ার্ড হিসাবে খেলে বেশ নামও করছে। আশা করা যাচ্ছে কলকাতা ময়দান কিছুদিনের মধ্যেই এক প্রতিভাবান ফরোয়ার্ড পাবে। কিন্তু পরের বছরেই ছন্দ পতন হয়ে গেল গরমের ছুটিতে।

বাড়িতে বসে আর কী করবে? দাদাও তখন বাংলা দলে, তাই মহারাজকে নিয়ে চণ্ডী গাঙ্গুলী গেলেন দেবু মিত্রের কাছে। ব্যস তারপর তো ইতিহাস, বাংলার ক্রিকেট পেল তার জীবন্ত কিংবদন্তিকে কিন্তু ময়দান হারালো এক উঠতি ফরোয়ার্ডকে। 

২০১০-এর ১২ নভেম্বর। সৌরভ যখন মহামেডান স্পোর্টিং-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে মহামেডান স্পোর্টিং প্ল্যাটিনাম জুবিলি কাপে খেলতে নামছিলেন, কোনোভাবে যেন সেই ফেলে আসা দিনগুলোই ঝিলিক মারছিল। জার্সির পিছনে লেখা ৯৯ নম্বর। সেই ৯৯, যা ভারতীয় দলের অধিনায়কত্বের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিঠে সেঁটে গেছিল। আজ মহামেডানের অধিনায়ক হিসাবেও একই সংখ্যা। খেলা শুরুর বাঁশি বাজল। ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গেছেন কিন্তু ফিটনেস তখনও বজায় রেখে চলেছেন সৌরভ। ক্রিস্টোফারকে বক্সে রেখে সৌরভকে একটু নিচে রেখে শুরু করেছে মহামেডান। খেলা শুরুর ৭ মিনিটের মাথায় একটা লুজ বল পেয়ে তিনি ছোট্ট একটা স্প্রিন্টে পেনাল্টি বক্সের ডি-এর কাছে পৌঁছে ডান পায়ের ইনস্টেপ দিয়ে পাস বাড়ালেন বাঁদিকে ফাঁকায় থাকা ক্রিস্টোফারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্য সহায়তা করল না মহামেডানের, গোলরক্ষক নাসিম আখতারকে দর্শক বানিয়ে বল উড়ে গেল গ্যালারির দিকে, ‘বাপি বাড়ি যা’। হতাশ সৌরভও মাথা নিচু করে কৃত্রিম ঘাসের উপর শিশির বিন্দুতে চিকচিক করা উড়ে যাওয়া বলটা দেখতে চেষ্টা করলেন। 

কুছ পরোয়া নেহি। ২৪ মিনিট, ডান প্রান্ত থেকে কর্নার পেল মহামেডান স্পোর্টিং। গুটি গুটি পায়ে সেকেন্ড পোস্টের দিকে ১০ গজের বক্সের ঠিক বাইরে নিজেকে দাঁড় করালেন সৌরভ। ক্রিস্টোফারের কর্নার কিক হেড করে নামালেন শেখ মুমতাজ আর ফাঁকায় দাঁড়ানো সৌরভ চকিত সাইড ভলিতে ডিফেন্ডারদের জঙ্গলের থেকে বল বার করে প্লেস করলেন দ্বিতীয় পোস্টে, সকলে চিৎকার করতে যাচ্ছিল ‘গোওল’ বলে। কিন্তু না, বাস্তবের গলে এরকম রূপকথা হয় না হয় তো। ইস্টবেঙ্গলের গোলরক্ষক নাসিম আখতার ডান দিকে ঝাঁপিয়ে বলটি দৃষ্টিনন্দনভাবে গ্রিপ করলেন। এরপরেও বার দুয়েক ক্রিস্টোফারের জন্য বল বাড়ালেন বটে, কিন্তু গোল হল না। ৫৭ মিনিটে যখন আটত্রিশ বছরের সৌরভ গাঙ্গুলি মাঠ ছেড়ে বেরচ্ছেন তখন উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে সিটে বসে আছে বা হাততালি দিচ্ছে না। 

আরও পড়ুন
লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সৌরভ, দিচ্ছেন ৫০ লক্ষ টাকার চাল

অবিন্যস্ত চুল ডান হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে হাততালি দিয়ে দর্শকদের ধন্যবাদ জানিয়ে ডাগ আউটে ফিরে গেলেন সৌরভ। পরের ফাইনালেও নামার ইচ্ছে ছিল হয়তো কিন্তু সঞ্জু প্রধানের ইনজুরি টাইমের পেনাল্টিতে মহামেডান হেরে গেল সেই সঙ্গে, মোহনবাগানের সঙ্গে ফাইনাল খেলার স্বপ্নও মাঝপথে ব্রেক মেরে থেমে গেল সৌরভ গাঙ্গুলির। 

অথচ কৈশোরের ওই দু চারটে বছর কখনও কি মনে হয়নি, সবুজ মেরুন জার্সি পরে গোষ্ঠ পাল সরণীর পাসের মাঠটির প্রতিটি ঘাসে নিজের ঘাম, রক্ত, পরিশ্রমের চিহ্ন রেখে যেতে পারেন তিনি? মোহনবাগানি তিনি, ক্রিকেট খেলেছেন মোহন বাগানের হয়ে। কিন্তু সবুজ মেরুন জার্সিটা গায়ে তোলা হয়নি কখনও। ইস্ট বেঙ্গলের বিপক্ষে খেলার আশৈশব লালিত ইচ্ছাটি সাদা কালো জার্সির মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত হল। 

তবু যদি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখি, জন্মদিন থেকে আর মাত্র দু’দিন পরেই ঐতিহাসিক এটিকে-মোহনবাগানের বোর্ড মিটিং, সৌরভ যে বোর্ডের এক সদস্য। ফুটবলের মাঠে তাঁর বর্তমানে বহুলচর্চিত প্রশাসনিক রূপ নিয়ে আগেই এসেছেন, এটিকে-র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে। আর দুদিন পরে হয়তো আপামর মোহনবাগানিরা তাঁর ফুটবলে প্রশাসনিক ক্ষমতার পরিচয় পাবেন। আশা করা যায় যেভাবে বুক চিতিয়ে বারবার তিনি ক্রিকেটের ময়দানে অধিনায়ক হিসাবে দলের ভার কাঁধে তুলে নিয়ে বৈতরণী পার করিয়েছেন, ফুটবল প্রশাসক হিসাবেও এই অনিশ্চয়তার পৃথিবীতে বাংলার ফুটবলকে আশার আলো দেখাবেন।

আরও পড়ুন
কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার জন্য, সরকারকে ইডেন গার্ডেনস দিতে প্রস্তুত সৌরভ

চ্যাম্পিয়নরা যে কোনও পরিস্থিতিতেই পড়ুক না কেন, ঠিক নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়। যে খেলাটায় মাঠা কাঁপাতে পারতেন, সেই খেলাটায় প্রশাসক হিসাবে আটচল্লিশের সৌরভের প্রস্ফুটিত হবার এই তো সময়! বরাবরের মতোই ছড়িয়ে পড়ুক তাঁর সুগন্ধ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More