১৯৮৬ সাল, চেন্নাই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেদিন ভারত। তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে সেদিন খানিকটা অসুস্থতার সঙ্গেই শুরু মাঠে নেমেছিলেন ডানহাতি অজি ব্যাটসম্যান। উষ্ণ আবহাওয়ায় বার বার বমি আর ক্লান্তিই যেন কাবু করে দিচ্ছিল তাঁকে। ক্যাপটেন অ্যালান বর্ডার তাঁকে ঔদ্ধত্যের সঙ্গেই বলেছিলেন পিচ থেকে সরে দাঁড়াতে। ‘রিটায়ার্ড ইল’-এর সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে সুযোগ করে দিতে মাঠে নামার। আর সেটাই যেন ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্ত হয়ে গেল তাঁর কাছে। ২১০ রানের বিরাট টেস্ট ইনিংস খাড়া করলেন তিনি সেই অবস্থাতেই। যা আজও ভারতের বিরুদ্ধে করা কোনো অজি ক্রিকেটারের টেস্ট রেকর্ড। ডিন জোনস। অস্ট্রেলিয়ার সেই কিংবদন্তি ক্রিকেটারই প্রয়াত হলেন মুম্বাইতে।
মৃত্যু যে কত আকস্মিক হতে পারে, তা সত্যিই অকল্পনীয়। গতকাল রাতেও আইপিএলের ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন তিনি। গতকালের কলকাতা আর মুম্বাইয়ের ম্যাচ ছাড়াও আইপিএলের অন্যান্য ম্যাচগুলিতেও নিয়মিত কমেন্টেটরের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন চলতি মরসুমে। কাজের সূত্রে ছিলেন মুম্বাইতেই, সেখানেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে চিরবিশ্রাম নিলেন ডিন জোনস। ঘুরে দাঁড়ানোর সময় টুকুও পেলেন না তিনি। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৯ বছর।
১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক হয় জোনসের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে। সুযোগটা এসে গেছিল আকস্মিকই। বাড়তি খেলোয়াড় হিসাবেই দলে থাকা ডিন জোনস প্রথম একাদশে জায়গা পেয়েছিলেন গ্রাহাম ইয়ালোপের অসুস্থতার কারণে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে চূড়ান্ত সাফল্য তো ছিলই। তা-ই যেন প্রতিফলিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইশ গজে। তারপর থেকে পাকাপাকিভাবেই জায়গা করে নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে। হয়ে উঠেছিলেন সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে অস্ট্রিলিয়ার চূড়ান্ত সাফল্যের পিছনেও ভূমিকা রয়েছে এই অজি ডানহাতি ব্যাটসম্যানের। মিডিল অর্ডারে অস্ট্রেলিয়ার ত্রাতা হয়েই উতরে দিয়েছেন বহু ম্যাচ। ফিরিয়ে এনেছেন ম্যাচের পরিস্থিতি। ফিল্ডিংয়েও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয় তাঁর দৌলতেই। ৩টি অর্ধশতক-সহ টুর্নামেন্টে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৩১৪ রান। প্রতি ম্যাচে ৪৪ রানের গড়। কার্যত তার পর থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটে অন্যতম শক্তি হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫২টি টেস্ট ম্যাচ এবং ১৬৪টি সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলেছেন ডিন জোনস। রয়েছে সব মিলিয়ে ১৮টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি এবং ৬০টি হাফ সেঞ্চুরি। একদিনের ক্রিকেটে গড় রান ৪৪.৬১। ১৯৯০ সালের বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারের সম্মানও জুটেছিল ডিনের। এসবের বাইরে ঘরোয়া ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ায় রানের পাহাড় গড়েছেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর সর্বোচ্চ ৩২৪ রানের ইনিংস এখনও মনে করিয়ে দেয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের কথা।
তবে মাত্র ১০ বছরেই ফুরিয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কেরিয়ার। ১৯৯৪ সালে শেষ কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যাট ধরতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু ক্রিকেট থেকে সরে যাননি কখনোই। ১৯৯৮ সাল অবধি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে গেছেন একটানা। তারপর জুড়ে গিয়েছিলেন কোচিং এবং ধারাভাষ্যের কাজে। আর তার মাঝেই চলত ধারাবাহিকভাবে ক্যানসার আক্রান্তদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি। তার মধ্যে যেমন ছিল সচেতনা গড়ে তোলা, তেমনই লক্ষ্য ছিল দুঃস্থদের চিকিৎসার জন্য ফান্ড গড়ে তোলা। ২০০৬ সালে ক্রিকেট এবং ব্যক্তিগত জীবনেও এই ব্যতিক্রমী চরিত্রের জন্য তাঁকে ‘অর্ডার অফ অস্ট্রেলিয়া’ সম্মান জানিয়েছিলেন দেশ।
আরও পড়ুন
অক্সিজেন ছাড়াই দশবার এভারেস্ট জয়, প্রয়াত 'স্নো লেপার্ড' অ্যাং রিটা শেরপা
জোনসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল অস্ট্রেলিয়ার এক দীর্ঘ ক্রিকেটের অধ্যায়। বিখ্যাত এই প্রাক্তন তারকার আকস্মিক প্রয়াণে শোকস্তব্ধ অস্ট্রেলিয়া-সহ সারা বিশ্বের ক্রিকেট দুনিয়া। তবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে কেমন যেন আত্মীয়তার সম্পর্কেই জড়িয়ে গিয়েছিলেন জোনস। ২০০৫ সালে ভারতের প্রধান কোচ হওয়ার জন্যও মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন তিনি। অথচ সে বছর ভারতের দায়িত্ব পান আরেক অস্ট্রেলিয়ান তারকা গ্রেগ চ্যাপেল। সেই ঘটনায় খানিকটা দুঃখিতই হয়েছিলেন জোনস। আফসোসও প্রকাশ করেছিলেন সংবাদ মাধ্যমে। তাঁর প্রায় দেড় দশক পরে ভারতের মুম্বাইতেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। স্বপ্নপূরণ, নাকি আক্ষেপই জুড়ে থাকল এই সমাপতনের সঙ্গে? জানা নেই...
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ওআরএস-কে এনে দিয়েছিলেন স্বীকৃতি, প্রয়াত কিংবদন্তি বাঙালি চিকিৎসক ডা. ধীমান বড়ুয়া