জীবন্মৃত অবস্থায় কাটত দিন; ১০০ বছর আগের ‘জম্বি’ মহামারীর রহস্য মেটেনি আজও

যাঁরা প্রাণ হারালেন, তাঁরা তবু বেঁচে গেলেন। যাঁরা শরীরে বেঁচে গেলেন, তাঁদের অবস্থা আরও করুণ। সারাটা জীবন যেন বেঁচে থাকতে হল ‘জম্বি’-র মতো। না, কোনো কল্পকাহিনির কথা বলছি না। মাত্র ১০০ বছর আগেই ইউরোপের বুকে হানা দিয়েছিল এমন এক মহামারী, যা মানুষকে জীবিত মৃতদেহে পরিণত করেছিল। ইতিহাসের এক অনালোচিত অধ্যায় অস্ট্রিয়ার ‘জম্বি’ মহামারী।

এক বছরের বেশি সময় ধরে উপদ্রব চালানোর পর অবশেষে শান্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস। আর এই সময়ে মানুষের স্মৃতিতে বারবার ফিরে এসেছে ইতিহাসের ভয়ঙ্কর কিছু মহামারীর কথা। ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া স্প্যানিস ফ্লু মহামারীর কথা তো এতদিনে কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঠিক সেইসময়েরই আরেক ভয়ঙ্কর মহামারীর কথা প্রায় অনালোচিতই থেকে গিয়েছে। কিন্তু তার রহস্য পরিষ্কার হয়নি এই ১০০ বছরেও। এনসেফেলাইটিইস ল্যাথার্জিকা। ১৯১৫ সাল নাগাদ অস্ট্রিয়ায় হঠাৎ আক্রমণ করে এই রোগ। আর বছর ১২-র মধ্যে সেই সংক্রমণ থেমেও যায়। তবে কোনো প্রতিষেধক তো দূরের কথা, রোগের কোনো কারণই খুঁজে পাননি চিকিৎসকরা।

অন্তত ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই মহামারীতে। তবে তাঁরা যেন মরে বেঁচে গিয়েছিলেন। আর যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। জীবনের কোনো অনুভূতিই আর কোনোদিন বুঝতে পারেননি। মস্তিষ্কের ক্রিয়া ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারোর কারোর। অথচ শরীর জীবিত ছিল। আর সেই শরীর নিয়েই টিকে থাকতে হয়েছিল কোনোমতে।

অস্ট্রিয়ার স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ভন ইকনমো প্রথম এই রোগের দিকে আলোকপাত করেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, গোড়ার দিকে একটু বেশি আলস্য আর ঘুমের আধিক্য ছাড়া প্রায় কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। কিন্তু সময় যত এগোতে থাকে, ততই বেশি করে রোগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শুরু হয় তীব্র মাথাব্যথা। কারোর কারোর ক্ষেত্রে পক্ষাঘাত পর্যন্ত ঘটে যায়। তবে কীভাবে এই রোগের সংক্রমণ দেখা গেল, সে-বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দিতে পারলেন না ইকনমো। এনসেফেলাইটিস ল্যাথার্জিকা নামটা তখনও জানা যায়নি। সবাই এই রোগের নাম হয়ে গেল ইকনমো’স ডিজিজ।

আরও পড়ুন
মহামারী রুখেও নোবেল পাননি 'নেটিভ' উপেন্দ্রনাথ

ইকনমো’স ডিজিজের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ল ঠিক সেই সময়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে। ইউরোপের হাজার হাজার তরুণ যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। অস্ট্রিয়ার যুবকরাও সামিল যুদ্ধে। যুদ্ধের ভয়াবহতার কাছে ইকনমো’স ডিজিজ হারিয়ে গেল। আর যুদ্ধের ভয়াবহতা শেষ হতে না হতেই এসে পড়ল স্প্যানিশ ফ্লু। অন্তত ৫ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই মহামারীতে। আর এইসব ঘটনায় যত মানুষ প্রাণ হারালেন, তার কাছে ইকনমো’স ডিজিজে মৃত মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম। তাই হয়তো ১০০ বছর পর আর তার ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা হয় না। কিন্তু যা আশ্চর্যের, তা হল মহামারী থেমে গেলেও তার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।

১৯২৭ সালের পর আর এই রোগের নতুন কোনো সংক্রমণ দেখা যায়নি। আক্রান্ত মানুষদের ৪০ শতাংশই প্রাণ হারিয়েছিলেন। যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের শরীর জীবিত থাকলেও কোনো অনুভূতি ছিল না। ফলে রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া একরকম অসম্ভব। তাও গবেষণা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। একসময় যখন বিজ্ঞানীরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখনই পাওয়া গেল এক নতুন সূত্র। ২০০৪ সালে ভাইরোলজিস্ট জন অক্সফোর্ড দেখলেন, মহামারীর পর বেঁচে যাওয়া প্রত্যেকের গলায় ইনফেকশনের কথা শোনা গিয়েছিল। এরপর তিনি খুঁজে দেখলেন, যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদেরও গলা শুকিয়ে যাওয়ার কথা ছিল মেডিক্যাল রিপোর্টে। আর সেই সমস্ত রিপোর্ট পরীক্ষা করতে গিয়েই দেখলেন, প্রত্যেকের গলাতেই এক বিশেষ ধরণের স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া বাসা বেঁধেছিল। এখনও অবশ্য এই রোগের সঙ্গে স্ট্রেপটোকক্কাসের সম্পর্ক সরাসরি প্রমাণ করা যায়নি। তবে যে অণুজীবই দায়ী হোক, তার কোনোরকম নিরাময়ের পথ আবিষ্কার হয়নি। আবারও যে সেই মহামারী ফিরে আসবে না, সেকথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

আরও পড়ুন
ছোট্ট মরুশহর ফিনিক্স, একটি বৃহৎ সামাজিক পরিবার এবং মহামারীর গল্প

Powered by Froala Editor