বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। বার্ধক্যের ভারে শেষ পর্যন্ত ফুরিয়েছিল সমস্ত লড়াই। অন্তিম যাত্রায় সাক্ষী ছিলেন শুধু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের আবাসিক অনাথ শিশুরা। কোনো নেতা-মন্ত্রী দূরের কথা, স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষরাও উপস্থিত ছিলেন না অন্তিম যাত্রায়। অথচ মৃত্যুর ২ বছর আগেই তাঁকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল সারা দেশে। ২০১৮ সালে শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন সুধাংশু বিশ্বাস। দেশের ৬৯তম প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন। হঠাৎ দেশবাসীর মনে পড়েছিল এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে। আর হঠাৎই মানুষ ভুলেও গেলেন সব কিছু। সেই বছরই ৭ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুধাংশু বিশ্বাস। কিন্তু ততদিনে আবারও সবাই ভুলে গিয়েছেন তাঁকে।
১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে রামকৃষ্ণপুর গ্রামে জন্ম সুধাংশু বিশ্বাসের। পরিবারের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের যোগাযোগ ছিল আগেই। স্বামী বিবেকানন্দের বাণীই তাঁকে ডেকে নিয়েছিল দেশের মুক্তির সংগ্রামে। আর কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসেই পেয়ে গেলেন আরেক শিক্ষককে। তাঁর নাম বেণীমাধব দাশ। শুরু হল জীবনের একটা অধ্যায়। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার পরিকল্পনা থেকে রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান, সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে ছিলেন তিনি। বীনা দাস, শিশির বসুর সহযোদ্ধা জেলও খেটেছেন। জেলের মধ্যে অনশনও করেছেন রাজনৈতিক বন্দির স্বীকৃতির দাবিতে। অবশেষে দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু সুধাংশু বিশ্বাসের লড়াই তখনও শেষ হল না।
স্বাধীনতার দোসর হয়ে এল দেশভাগ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে চলে এলেন সীমান্ত পেরিয়ে। তাঁদের নিয়েই একটা কারখানা গড়ে তুলেছিলেন সুধাংশু বিশ্বাস। তবে বাজারের প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত সেই কারখানা টিকল না। শেষ পর্যন্ত নিজের বাসভবনেই গড়ে তুললেন রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম। ১৯৭৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ৫০ জনের বেশি অনাথ শিশুর দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সুধাংশুবাবু বিশ্বাস করতেন, যে স্বাধীনতার জন্য তাঁরা লড়াই করেছেন তা এখনও মেলেনি। ভোটের রাজনীতির মধ্যে সেই স্বাধীনতা সম্ভবও নয়। তার জন্য প্রয়োজন স্বামীজির ‘ম্যান মেকিং মিশন’। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। কাঙ্খিত সমাজ দেখে যেতে পারেননি সুধাংশু বিশ্বাস। আদৌ কি কোনোদিন সেই সমাজের সন্ধান পাবেন মানুষ?
Powered by Froala Editor