উনবিংশ শতকের একদম শেষের সময়। সারা বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনে তো জ্বলছেই, সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিস চেপে বসেছে সবার ওপর। প্লেগ। তার আগে কলেরার প্রাদুর্ভাবো ঘটে গেছে। দিকে দিকে মানুষ মরছে; রাস্তায় রাস্তায় বসে আছে আর্তরা। হাসপাতালে, শ্মশানে নিয়ে যাওয়ারও কেউ নেই। ছুঁলেই যে থাবা বসাবে প্লেগ! এমন অবস্থায়, একজন বিদেশিনী সেই রোগাক্রান্ত ‘নেটিভ’দের মাঝে যাচ্ছেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন কাজে। এই মানুষগুলোকে তো বাঁচাতে হবে! খবরের কাগজগুলোয় আর্থিক সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করছেন। শহর অবাক হয়ে দেখল বিদেশিনীর এমন উদ্যোগ। ওঁর নাম সিস্টার নিবেদিতা…
তারপর পেরিয়ে গেছে বহু বছর। সম্প্রতি আরও একটি মহামারী হানা দিয়েছে গোটা বিশ্বে। করোনা। ভারত এবং এই পশ্চিমবঙ্গও ভুক্তভোগী এই রোগে। কলকাতাতেও আক্রান্ত হয়েছেন একজন। করোনা নিয়ে তাঁর ‘অবাধ বিচরণ’কে কেন্দ্র করে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া। এমন পরিস্থিতিতেই একটি ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে এল ‘প্রান্তকথা’। ৩৫ জন বৃদ্ধাদের কাছে অন্তত এক মাসের যাবতীয় খাবার, সরঞ্জাম পাঠানো হল। তাঁরা যাতে এই কদিন বাড়িতেই থাকেন, বাইরে যাতে না বেরোন, সেটাই নিশ্চিত করা হল। সেই সঙ্গে জুড়ে থাকল অনেকটা ‘আদর’।
রবীন্দ্র সরোবরের পেছনে যে বুদ্ধ মন্দিরটি রয়েছে, তার সামনেই এই বৃদ্ধারা এসে বসেন। কেউ থাকেন ঢাকুরিয়া, কেউ গড়িয়া, সোনারপুর। খানিক শান্তির খোঁজই বোধহয় চলে সবসময়। সকালবেলায় চলে আসেন তাঁরা; বেশি কিছু না, সামান্য একটু খাবারই তাঁদের চাওয়া। পথচলতি মানুষরা নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্য করেন। রাত হলে কেউ ফিরে যান, কেউ আবার ওই বুদ্ধের শান্তির কাছেই আশ্রয় নেন। এইভাবেই চলতে থাকে দিন।
কিন্তু সম্প্রতি করোনা ভাইরাস এই নিত্যদিনের রুটিনে সংশয় তৈরি করেছে। ওই অসহায় বৃদ্ধাদের তো যাওয়ার জায়গা নেই। এখানে না এলে, খাওয়ার জোগাড় কোথা থেকে হবে? ওই অশক্ত শরীরেও তাই চলে আসা এখানে। জানেন চারিদিকে এখন বিপদের ছোঁয়া, কিন্তু পেট যে মানে না! করোনার কথাও শুনেছেন, কিন্তু কী করে এই রোগ হয়, কী তার বৃত্তান্ত, সে সম্পর্কে কোনো খবরই পৌঁছয়নি সেখানে। তাঁরা যে অসহায়। এই বৃদ্ধ বয়সে, কে দেখবে তাঁদের?
সেখান থেকেই এই উদ্যোগ। আজ সকালবেলায় বুদ্ধ মন্দিরের সামনে ওই বৃদ্ধা ঠাকুমা, দিদিমাদের এক মাসের প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হল প্রান্তকথার পক্ষ থেকে। সেখানে যেমন রয়েছে খাবার, তেমনই রয়েছে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস। সেই সঙ্গে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সতর্কও করা হল। কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে, সমস্ত কিছু বোঝানো হল। যাতে আগামী এক মাস তাঁরা ঘর থেকে না বেরোন, সেটাই সুনিশ্চিত করা হল। ওঁরাও বুঝলেন, কথা দিলেন। দুই পক্ষের ‘আদর’ বিনিময়ে সকালটা হঠাৎ করেই যেন সুন্দর হয়ে গেল।
আমরা নিজেরা নিজেদের সুস্থতা নিয়ে ভাবছি। কেউ ঘরে রয়েছি, কেউ মাস্ক কিনে ফেলছি আগেভাগেই। করোনা নিয়ে যেমন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তেমনই ছড়াচ্ছে গুজব। কিন্তু সমাজটা তো কর্পোরেট দুনিয়া আর কংক্রিটের হাইরাইজ দিয়ে তৈরি নয়! এখানে জড়িয়ে রয়েছেন রবীন্দ্র সরোবরের এই বৃদ্ধাদের মতো অসহায় মানুষগুলোও। রয়েছে পথশিশু, ভিক্ষুকরা। তাঁদের সুরক্ষার কথা একবারও ভেবেছি কি? মহামারীর সময় নিবেদিতা, স্বামী বিবেকানন্দ-সহ অনেকে নিজেদের কথা না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেবায়। কাদের সেবায়? ওই অসহায় মানুষগুলোর সেবায়। ওঁরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সমাজ কোথায় যাবে? ‘প্রান্তকথা’ ও ‘আদর’-এর এই উদ্যোগ আমাদের সেই দায়িত্বগুলির কথাই মনে করিয়ে দেয়। আসুন না, চারিদিকের মানুষগুলোর দিকেও আমরা হাত বাড়িয়ে দিই। সবাই মিলে একটা সুস্থ পৃথিবী তৈরি করি। দোষারোপ না হয় পরেও করা যাবে। আগে মানুষদের বাঁচাই!