তাঁবুর ভেতর সার দিয়ে রাখা বিছানা। রোগীরা শুয়ে আছে। আর্তনাদ, আশঙ্কা, চিন্তা। জীবন আর মৃত্যুর মাঝের একটা রাত। সব চুপচাপ। হঠাৎ কোথা থেকে জেগে উঠল আলো। ক্ষীণ, কিন্তু স্থির নয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে সেটি। তাঁবুটার গুমোট অন্ধকার কেটে গেল এক লহমায়। একটা অবয়বও সেই আলোর সঙ্গে এগিয়ে এসেছে। প্রতিটা বিছানার পাশে এসে ঘুরে যাচ্ছে। সবাই ঠিক আছে তো? সুস্থ আছে তো? রোগীরা অবাক হয়ে যায়। এ কীসের আলো! আর এই মেয়েটি; যেন আশার দেবী! ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। ওই আবহে এমনই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
আরও পড়ুন
‘দরকার হলে বেলুড় মঠের জমি বিক্রি করে দেব’, মহামারী রুখতে সংকল্প বিবেকানন্দের
পৃথিবীতে যেন এসেইছিলেন সেবা-র কথা বলতে। সেবা-র আলো ছড়িয়ে দিতে। যখনই কেউ বিপদে পড়তেন, যন্ত্রণায় কাতরাতেন, পাশে পেতেন তাঁকে। নার্সিং - এই পেশাটিকেই ছোটো থেকে ধ্যান জ্ঞান করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। জন্ম নিয়েছিলেন ধনী পরিবারে। সুখ ছিল, স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। ছিল নিশ্চয়তা। তাও সব ছেড়ে কেন চলে এসেছিলেন রাস্তায়? পৌঁছে গিয়েছিলেন রোগগ্রস্ত মানুষগুলির মধ্যে? সব প্রশ্নের উত্তর কি এত সহজে দেওয়া যায়? ফ্লোরেন্সও উত্তর খুঁজেছিলেন। খুঁজতে খুঁজতেই চলে যাওয়া নার্সিং স্কুলে। সেখান থেকে লন্ডনের একটি হাসপাতালে। সেখানেই শুরু কর্মজীবন।
আরও পড়ুন
মহামারী রুখতে পথে রবীন্দ্রনাথ, ঘরছাড়া জগদীশচন্দ্র; মারা গেল অবনীন্দ্রনাথের ছোট্ট মেয়ে
যে সময়টা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এসেছিলেন, সেটা উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ। নার্সিংকে খুব সম্মানের চোখে দেখাও হত না। অথচ দিনের শেষে ডাক্তারদের সঙ্গে এরাই ছিল ভরসা। আজকের অবস্থা দেখে হয়তো বোঝাও যাবে না সেই পরিস্থিতি। সেই সময়, একজন সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে, সব ছেড়ে এই পেশাকে গ্রহণ করল। অবাক তো হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু ফ্লোরেন্সের তো অবাক হলে চলবে না! তাঁকে যে স্রষ্টা পাঠিয়েছেন সেবিকা হওয়ার জন্যই। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে প্রচুর অবদান রেখেছিলেন তিনি। তবে এইসবের সঙ্গে আরও একটি জিনিসের জন্য গোটা বিশ্ব মনে রাখবে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে। যার পটভূমি ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধ।
আরও পড়ুন
সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই
১৮৫৩ সালে ইংল্যান্ড আর রাশিয়ার মধ্যে শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ। শুরু হল তো বটে; এদিকে এক বছরের মধ্যেই সৈন্যদের অবস্থা কাহিল! প্রায় ১৬ হাজারেরও বেশি সৈন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়। তবে এমন অবস্থার কারণ শুধু যুদ্ধই ছিল না। রণাঙ্গনের থেকেও লড়াইটা কঠিন ছিল অন্য জায়গায়। একসঙ্গে ম্যালেরিয়া, কলেরা-সহ অন্যান্য রোগ গ্রাস করেছিল তাঁদের। মহামারী লেগে গিয়েছিল প্রায়। আর হবে নাই বা কেন! হাসপাতালের পরিস্থিতি ও পরিবেশও যে খুব স্বাস্থ্যকর ছিল না। নার্স, প্রয়োজনীয় ওষুধ, জল, ডাক্তার— সবকিছুরই অভাব ছিল। ফলে, জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছিল মারাত্মকভাবে।
আরও পড়ুন
মহামারীতে ছারখার বাংলা, মৃত ৫০ হাজারেরও বেশি, বাদ গেল না সাহেবরাও
এমন অবস্থাতেই এগিয়ে এলেন বছর ৩৪-এর এক নারী। নিজের নার্সের দল নিয়ে পৌঁছে গেলেন অকুস্থলে। গিয়ে দেখলেন, যা ভেবেছিলেন তার থেকেও খারাপ পরিস্থিতি। কোনো কিছুই স্বাস্থ্যকর নয়। পরিষ্কার কাপড় নেই, ভালো খাবার নেই, ওষুধ নেই। কেমন করে বাঁচবে মানুষগুলো? এমন অবস্থায় আছে! এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও খুব বেশি সাহায্য করছেন না। অগত্যা একাই ময়দানে নেমে পড়লেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। সঙ্গে ছিল তাঁর গোটা দল। হাসপাতালের অবস্থা যেন হঠাৎ করেই বদলে গেল। যাতে ঠিকঠাক আলো-বাতাস ঢোকে ঘরে, কোনোরকম নোংরা যাতে জমতে না পারে সেই সবকিছু নিশ্চিত করলেন তিনি। রোগীদের জামাকাপড় যেন পরিষ্কার থাকে, সেটাও খেয়াল রাখলেন তিনি। একদিকে কাজের দিকে কঠোর, অন্যদিকে অসম্ভব মমতা; ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যেন হয়ে উঠলেন বেঁচে ওঠার সেই নৌকা। ওই সৈন্যরাও ভরসা পেলেন। তাঁদের মনে আরও আশা তৈরি হল, যখন দেখলেন গভীর রাতে একটা ল্যাম্প জ্বালিয়ে ফ্লোরেন্স নিজে এসে সবাইকে দেখে যাচ্ছেন। ইনি থাকতে তাঁরা কী করে মারা যান! হতেই পারে না…
আরও পড়ুন
মহামারীর জন্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, ঘরে বসেই মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার নিউটনের
আর শেষ পর্যন্ত ফলাফল? সৈন্যদের মৃত্যুহার ৪২ শতাংশ থেকে নিয়ে এলেন ২ শতাংশ। পুরো হাসপাতালেরই ভোল বদলে দিয়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তিনি না এলে ঠিক কী হত, কে জানে! মহামারীর গুরুত্ব ঠিকই বুঝেছিলেন তিনি। এক জায়গায় থেকে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতাই যে পথ, সেই সঙ্গে দরকার সঠিক চিকিৎসা— পুরো ব্যাপারটাই সুনিশ্চিত করেছিলেন তিনি। আজকের এমন পরিস্থিতির দিকে তাকালে আরও এক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকেই হয়তো মনে পড়বে সবার। যিনি আলো হাতে সবার কাছে এসে দাঁড়াবেন; আর সেই পরশটুকু নিয়ে আমরাও লড়াইয়ের মন্ত্র পাব।