একদিনে অজয়, অন্যদিকে ভাগীরথী দাপটে এ অঞ্চল খুব সমৃদ্ধ, আসলে তাদের হাতেই থাকে সৃষ্টি ও ধ্বংসের সমস্ত চাবিকাঠি। আজ বিজয়া দশমী। জল নেমে গেছে বাড়ির উঠোন থেকে। এখনও উঁচু হয়ে পলি জমে আছে উঠোনে। তুলসী মন্দিরের গায়ে, মাটির দাওয়ার গায়ে নোনা দাগ রেখে গেছে বন্যার জল। অথচ এই তো কিছুদিন আগেও জমিতে মেশিন দিয়ে জল দেওয়ার জন্য মোটা টাকা ধার নিতে হয়েছিল মহাজনের কাছে। সে টাকা এখনও শোধ হয়নি। এর মধ্যে আবার বন্যার ভ্রূকুটি। একসময় পূর্ববঙ্গ থেকে শ'য়ে শ'য়ে মানুষ এসেছিল ঈশানী নদীর পারে। ভূমিহীন এইসব মানুষগুলি প্রথম থেকেই শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শর্তানুসারে জমি নিয়ে ভাগ-চাষ। জমি অন্যের, শ্রম তাদের। এই যৌথকারবারে জমিতে ফলানো হত সোনালি ফসল। তবে শুধু তারা নয়, আশেপাশের প্রান্তিক চাষিদেরও মূল জীবিকা ভাগ-চাষ।
তীব্র খরায় যখন জমি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। ঈশানী বুকেও একফোঁটা জল নেই। চারদিকের সবুজভূমি শুকিয়ে যেন ধূসর হয়ে আছে। এমন সময় সুজন কাকা এসে বলল, 'আপনাদের জমিটা চাষ করতে চাই এবার, যদি এবারের জন্য দিতেন তাহলে খুব ভালো হত'। আমার বাবা উত্তর দিল, 'কিন্তু এবার তো কেউ চাষ করতে চায়নি এত খরাতে।' সুজন কাকা ছাড়বে না কিছুতেই। তার চোখে অনেক স্বপ্ন। সে বলে চলল, 'আপনি এক বছরের জন্য একবার দিয়ে দেখুন আমি গায়ে গতরে খেটেও ওখানে ধান ফলাব।' সুজন কাকার ভালো নাম সুজন বর্মণ। খুব ছোটবেলায় সে তার বাবার হাত ধরে বর্ডার পার হয়ে এসেছিল মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ানে। তারপর এদিকওদিক হয়ে শেষে এসে বাসা বেঁধেছিল ঈশানীর পারে। আমাদের জমিতে আগে যে চাষ করত, সেই রবি কাকা আর তাঁর ছেলে দুজনেই কেরালাতে চলে গেছে জনমজুরের কাজে। জমি চাষ করে তারা লাভ খুঁজে পায় না। তারা বলে, 'এখন চাষার ছেলে চাষ করলে বাড়িতে হাড়ি চাপবে না, শালা এক বছর মারে টানে, তো অন্য বছরে বানে এসে সর্বস্ব গিলে খায়।' ওরা তাই বহু জমির ভাগ চাষ ছেড়ে, এমনকি নিজের জমির চাষ অন্যকে ভাগ-চাষে দিয়ে কেরালায় চলে গেছে লেবারের কাজে। তাতে দু বছরের মধ্যে বাড়িতে কল বসিয়েছে, পায়খানা তৈরি করেছে, এক ছেলেও বিয়েও দিয়েছে, অথচ আগে চাষ করে দু’বেলার ভাত জোটাতেও তাদের হিমসিম খেতে হত।
রবি কাকা কেরালা চলে যাওয়ার পর দু’বছর জমিটা কেউ করেনি, পড়েই ছিল। তাই সুজন কাকা এসেছিল আমাদের জমির দায়িত্ব নিতে। দায়িত্বও নিল অভিভাবকের মতো। বর্ষাতে এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই আকাশে কিন্তু নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে পাম্প মেশিন চলিয়ে জল দিল, অন্যের লাঙল ভাড়া নিয়ে জমির বতর তৈরি করল, তারপর যখন সবুজ ধানে জমি ভরে উঠল তখন তাঁর চোখেমুখে সে কী আনন্দ! সে ভাবছিল দুর্গাপূজার পর নতুন ধান উঠলে তার সমস্ত ঋণ শোধ হয়ে যাবে, ধার করে চাষ করেও তার দু পয়সা লাভও হবে কিন্তু সবসময় তো ভাগ্য পাশে থাকে না।
মহালয়ার দিন থেকে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। বিহারে বন্যা। ঝাড়খণ্ডে বন্যা। একদিনে অজয় উপচে পড়ছে। অন্যদিকে ফারাক্কার সব গেট দিয়ে প্রবল বেগে বেরিয়ে আসছে লাল জল। ভাগীরথী বিপদসীমার উপরে বইছে। অজয় উত্তর রাঢ়ের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে বইছে। তাতে ঈশানীও বইছে বানভাসি হয়ে, কারণ একদিকে ভাগীরথী, অন্যদিকে অজয়ের জলের চাপে আজ এই ছোট্ট নদীটাও ফুলেফেঁপে উঠেছে, অথচ কদিন আগেই তার বুকে একফোঁটাও জল ছিল না। সপ্তামীর দিন সুজন কাকা এসেছিল আমাদের বাড়ি খুব ভোরে। সে বলল ভোলাডাঙা, ময়রাপুকুর মাঠ, ঝোলার মাঠ ডুবে গেছে, অর্থাৎ আমাদের জমি ও তার বোনা স্বপ্নও ডুবে গেছে বানের জলে। সুজন কাকাকে সেদিনই প্রথম কাঁদতে দেখলাম ভোরবেলায়। এত শক্তিশালী মানুষ কেমন যেন ভেঙে পড়েছে। বন্যা, বৃষ্টির জন্য এবার সে জমিটাকে বাঁচাতে পারেনি অথচ দু’দিন আগেই খরায় খুব আশা নিয়ে ধান লাগিয়েছিল। সুজন কাকা বারবার বলছিল রবিই ঠিক কথা বলত, এ শালা একবার বানে খায়, একবার টানে মারে আমাদের। চাষির কপালটাই খারাপ। এবার পূজা চলেও গেল কিন্তু ছেলেমেয়েদের একটা জামাও দিতে পারেনি।
আজ বিজয়া দশমী। দুপুর হয়ে এসেছে। বনেদিবাড়ির দুর্গা প্রতিমাগুলোকে বিসর্জন করার প্রস্তুতি চলছে। রবি কাকার বাড়ির ছেলে মেয়ে, কচি কাঁচারা বাজি পটকা ফাটাচ্ছে। অথচ সুজন কাকার বাড়ি আশ্চর্যরকমভাবে শান্ত, যেন তাদের বাড়িতে পূজা এখনও আসেনি। অথচ দূরে ওটা যে কে যাচ্ছে লাঙল কাঁধে নিয়ে মাঠে, হ্যাঁ সুজন কাকাই তো! ও জমির উপরে পড়ে থাকা পলি তুলে ফেলতে যাচ্ছে? সাথে ওটা কে? ওর ওইটুকু ছেলেও যাচ্ছে লাঙল দিতে? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। জমির পলি তুলে দিয়ে সুজন কাকা হয়ত আবার আমন চাষ করবে! আজ বিজয়া দশমীর দিনে সব কিছুই বিসর্জন হয় না হয়ত, সুজন কাকা কি রবিকাকার কথা মিথ্যা প্রমাণ করতে আজ মাঠে গেছে?