২০০৪ সাল, ভারতের ক্রিকেট দলে তখন এক ঝাঁক উজ্জ্বল তারকা। সচিন-সৌরভ-দ্রাবিড়-সহবাগ কে নেই? তার মধ্যেই নতুন এক ব্যাটসম্যান আত্মপ্রকাশ করলনে। বয়স বছর ২৩। লম্বা দোহারা চেহারা, লম্বা চুল। কিন্তু প্রথম প্রথম জাতীয় দলে প্রতিভার তেমন নিদর্শন দিতে পারলেন না তিনি। প্রথম ম্যাচে শূন্য রানেই আউট। পরের তিনটি ম্যাচে যথাক্রমে ১২, ৭ এবং ৩। কিন্তু এরপর জাতীয় দলের পঞ্চম ম্যাচেই নজর কাড়লেন নবাগত সেই তরুণ। বিপক্ষ দলে তখন প্রবল পরাক্রমী পাকিস্তান।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে এমনিতেই দর্শকদের উত্তেজনা থাকে তুঙ্গে। সেবারেও ছিল তাই। প্রথমে ব্যাট হাতে নামল ভারতীয় দল। দর্শকদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে উপস্থিত সচিন তেন্ডুলকর। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে লাইমলাইট কেড়ে নিলেন নবাগত তরুণ। ১২৩টি বলে ১৫টি বাউন্ডারি এবং ৪টি ওভার-বাউন্ডারি সহ মোট রান দাঁড়াল ১৪৮। আর দলের মোট রান ৩৫৬। এরপর পাক বাহিনী নেমে অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ৫৮ রানে পিছিয়ে পড়ল। আর স্টেডিয়ামে উপস্থিত বা ঘরে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা দর্শকরা চিনতে পারল, ভারতীয় দলের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন এক যোগ্য ব্যাটসম্যান। যার ব্যাটের আঘাতে বল ছুটে যায় কামানের গোলার মতো।
সেদিনের সেই নবাগত তরুণটি আর কেউ নন, জাতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম সফল ক্যাপ্টেনদের একজন। মহেন্দ্র সিং ধোনি। গতকাল দেশের স্বাধীনতা দিবসের দিন ২২ গজ থেকে অবসরের কথা জানিয়েছেন তিনি। আর এই ঘোষণা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ১৬ বছরের ক্রিকেট জীবনের অসংখ্য অনবদ্য ইনিংসের কথা। প্রথম নজর কাড়া ইনিংসের কথা তো আগেই বললাম। সেদিন সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গাঙ্গুলিদের পাশে নাম তুলে নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাকেই অবলীলায় সম্ভব করে তুলেছিলেন ধোনি। ঠিক যেমন অবলীলায় বাউন্ডারির ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন একেকটি বল।
এরপর ধোনির জীবনে এত সফল ইনিংসের নমুনা আছে যে, তার মধ্যে থেকে সেরাগুলি বেছে নেওয়া বেশ কঠিন কাজ। তবে একদিনের ম্যাচের কথা বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হয় ২০০৫ সালে জয়পুরে অনুষ্ঠিত ভারত-শ্রীলঙ্কা সিরিজের কথা। প্রথম দুটি ম্যাচে ভারতীয় দল পিছিয়েই পড়েছিল। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচেই সবাইকে অবাক করলেন ধোনি। ১৮৩ রানেও তিনি অপরাজিত। শ্রীলঙ্কার ২৯৯ রান হয়তো ভারতের কাছে অধরাই থেকে যেত ধোনির সেই অসাধারণ পারফর্মেন্স ছাড়া। আর এরপর ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের কথা তো সবারই মনে থাকবে। সেবারেও প্রতিপক্ষ সেই শ্রীলঙ্কা। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৭৫ রানের লক্ষমাত্রা স্থির করে দিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, একেকটি বলও যেন এগিয়ে আসছে কামানের মতো। কিন্তু ভারতীয় দলের নেতৃত্বে যে তখন আছেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’। যুবরাজ সিং-এর সঙ্গে সমানে সঙ্গত দিয়ে গেলেন অধিনায়ক ধোনিও। আর ২৮ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ এল ভারতের মাটিতে।
আরও পড়ুন
ধোনির সঙ্গে একই পথে হাঁটলেন সুরেশ রায়না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বাঁহাতির
তবে শুধু একদিনের ম্যাচেই নয়, ক্রিকেটের সমস্ত বিভাগেই ব্যাটিং এবং উইকেট কিপিং-এ প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন ধোনি। টেস্ট ক্রিকেটের কথা বলতে গেলে ২০১৩ সালের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টানটান ইনিংসের কথাও বলতেই হয়। ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলেছে একটি ইনিংস। উল্টোদিকে মাইকেল স্টার্কের মতো বোলারও হতভম্ব। ২২৩ রানের সেই অনবদ্য ইনিংস প্রত্যেক ক্রিকেট দর্শকের মনে থেকে যাবে। আর মনে থেকে যাবে ২০১৭ সালে টি-২০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়লাভ। ভারতের মোট রান ২০২। আর ধোনির একক রান ৫৬।
আরও পড়ুন
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, স্বাধীনতা দিবসের দিনেই এল ঘোষণা
এরপর থেকেই বারবার ধোনির মুখে শোনা যাচ্ছিল ক্লান্তির কথা। প্রথমে অধিনায়কত্ব থেকে অবসর নিলেন। তারপর একাধিকবার শোনা গিয়েছে, ক্রিকেট থেকেই অবসর নিতে চলেছেন ধোনি। মাস দুয়েক আগেও যদিও সেসব জল্পনা হাসিমুখে উড়িয়ে দিয়েছেন ধোনি। কিন্তু অবশেষে সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। আর এভাবেই শেষ হল ভারতীয় ক্রিকেটের একটি অধ্যায়। ২২ গজের মাঠে ধোনি না থাকলেও এমন অসংখ্য ইনিংসের কথা মনে থেকে যাবে ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয়দের।
আরও পড়ুন
না চাইলেও থামতে হয় – অবসরে সেটাই বুঝিয়ে দিলে, প্রিয় ক্যাসিয়াস
Powered by Froala Editor