১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে বসলেন লর্ড ডালহৌসি। শুরু থেকেই তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী বীজকে বুনতে ইনফ্রাস্টাকচার ডেপেলমেন্টের দিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। রেল, টেলিগ্রাফের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে ভারতের কৃষির সঙ্গে শিল্পোন্নতির দিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। বম্বে, আমেদাবাদে যেমন কাপড়ের কলগুলো তৈরি হয়, তেমনই হাওড়া-হুগলিতে গড়ে ওঠে পাটকে কেন্দ্র করে নতুন একটি শিল্পাঞ্চল। কিন্তু শুরুর সময় থেকেই শিল্পক্ষেত্রগুলিতে শ্রমিকদের উপর জোর জুলুম লেগেই থাকত। তাদের কর্মসময় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল অথচ কারণে অকারণে বেতন কমে যাচ্ছিল তাই শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছিল শিল্পক্ষেত্রগুলিতে।
বাংলাতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে শশীভূশণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতে প্রথম 'শ্রমজীবী সমিতি' গঠন করেন এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তিনি ভারতের শ্রমিক সমস্যাগুলি 'ভারত শ্রমজীবী' পত্রিকায় তুলে ধরেন। একইভাবে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘দীনবন্ধু’ নামে একটি ইঙ্গ-মারাঠি পত্রিকার মাধ্যমে কাপড় কলগুলিতে শ্রমিক অসন্তোষের কথা তুলে ধরেন নারায়ণ মেঘাজি লোখাণ্ডে। এই পত্রিকার মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষের বিভিন্ন কথা ব্রিটেনেও পৌঁছেছিল সেইসময়।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মেঘাজি লোখাণ্ডের সভাপতিত্বের মাধ্যমে 'বোম্বে মিল অ্যান্ড মিলহ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতিই বম্বের শ্রমিকদের কাজের সময় হ্রাস ও ন্যূনতম বেতনের দাবিতে বহু সভার আয়োজন করেছিল এবং ব্রিটিশদের কাছে তুলে ধরত সমস্ত দাবিগুলি। এইসময় থেকে ভারতের শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি শুরু হয়। এর ফলস্বরূপ, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে ভারতে প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট পালন করেন। এই ধর্মঘটের কথা বালগঙ্গাধর তিলক মাসের পর মাস তাঁর কেশরি এবং মারাঠা পত্রিকাতে তুলে ধরেন এবং ধর্মঘটকারী প্রতি সমর্থন জানান। এই ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে বিপিনচন্দ্র পাল এবং জি সুবাহ্মণ্য আইয়ারের মতো নেতারাও দেশজুড়ে সমর্থনের আওয়াজ তোলেন।
এদিকে, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে, হাওড়ায় বার্ন আয়রন ওয়ার্কস কর্মীরা ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে বিরাট ধর্মঘট পালন করেন। তার ফলে অক্টোবর মাসের ২১ তারিখে শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে 'প্রিন্টার্স অ্যান্ড কম্পোজিটার্স লিগ' তৈরি হয়, প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল বাংলার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে কাজে যোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পালন করেন রাখিবন্ধন। স্বদেশি আন্দোলনের সময়েই শ্রমিক নেতা হিসাবে অশ্বিনী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার রায়চৌধুরীর মতো নেতাদের উত্থান হয় বাংলায়।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াতে বলশেভিক বিপ্লব হলে, ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে কমিউনিস্ট প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১৯১৭-তেই জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ভারতের প্রথম মহিলা কংগ্রেস সভানেত্রী হিসাবে অ্যানি বেসান্ত মহান রুশ বিপ্লবের আদর্শের কথা তুলে ধরেন। মাদ্রাজে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বি পি ওয়াদিয়া নেতৃত্বে ভারতের প্রথম আধুনিক ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন গঠিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে বিহারের চম্পারণ সত্যাগ্রহের সফলতার পর মহাত্মা গান্ধী আমেদাবাদ টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন। ক্রমাগত মালিকপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করে শ্রমিকদের দাবিগুলি মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি আমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন, পরে যা মজুর মহাজন নামে বেশি পরিচিতি লাভ করে। এই বছরেই ৩১ অক্টোবর বম্বেতে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করা হয় ওয়াদিয়া, তিলক, এম এম যোশি, যোশেফ ব্যাপ্তিস্তা, লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে। জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন দেওয়ান চমনলাল।
এরপর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আমেদাবাদ, বম্বের শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন, যা হিংসাত্মক আন্দোলনের রূপ নেয়। এই ধর্মঘটের সমর্থনে আসামের চা বাগানে ১২ হাজার শ্রমিক চা বাগান ছেড়ে নিজেদের বাড়ি ফিরে গেলে, ইংরেজের পোষা গোর্খা সেনারা চাঁদিপুর ঘাটে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। হাজারের উপর শ্রমিকের নির্বিচারে মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে পূর্ব রেলওয়ের সমস্ত বিভাগে এবং পদ্মা নদীর প্রতিটি স্টিমার ঘাটে শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয় এম এম রায়ের নেতৃত্বে। তরুণ ছাত্র এস এস ডাঙ্গে বম্বেতে সোশালিস্ট সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রচার করেন।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের একটি বিরাট শ্রমিক সমাবেশে শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চিট্টিয়ার ভারতের মাটিতে প্রথম মহান মে দিবস পালন করেন এবং শ্রমিকের স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেন। সেই শুরু। আজও অবিচ্ছিন্নভাবে চলছে সেই ধারা।
ঋণঃ-
১. স্বাধীনতা সংগ্রাম - বিপান চন্দ্র, অমলেশ ত্রিপাঠী
২. ইন্ডিয়ান মর্ডান হিস্ট্রি - রাজিব আহির
৩. পলাশি টু পার্টিশন - এস সরকার
Powered by Froala Editor