আজ থেকে এক শতক আগেও ‘সি ফুড’-এর প্রচলন সীমাবদ্ধ ছিল কোরিয়া, জাপান, চিন, ইন্দোনেশিয়ার মতো পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলিতে। তবে ক্রমশ বদলেছে সেই ছবি। ভারত তো বটেই বিশ্বজুড়ে চাহিদা বেড়েছে অক্টোপাস, লবস্টার কিংবা স্কুইডের। আর মানুষের এই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনই ক্রমশ বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এইসব সামুদ্রিক প্রাণীদের। এবার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে তাই কৃত্রিমভাবে অক্টোপাস (Octopus) প্রতিপালনের পথে হাঁটল স্পেনের সংস্থা (Spanish Farm)।
নুয়েভা পেসকানোভা। স্পেনের এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিই এবার তৈরি করতে চলেছে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক অক্টোপাস খামার। আর ২০২৩ সাল থেকেই বাজারে চলে আসবে তাদের ‘উৎপাদিত’ অক্টোপাস। তবে স্প্যানিশ সংস্থার এই সিদ্ধান্তকে ঘিরেই ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে বিতর্ক। বাণিজ্যিকভাবে অক্টোপাস প্রতিপালনের বিরোধিতায় মুখর হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর মানুষের খিদে মেটাতে বিশ্বজুড়ে শিকার করা হয় ৩.৫ লক্ষ টন অক্টোপাস। যা ১৯৫০ সালের পরিসংখ্যানের প্রায় ১০ গুণ। স্প্যানিশ খামারটির বিবৃতি অনুযায়ী এবার থেকে প্রতিবছর ৩ হাজার টন অক্টোপাস উৎপাদন করবে নুয়েভা পেসকানোভা। ফলে, খানিকটা হলেও মানুষের আগ্রাসনমুক্ত হবে বন্য অক্টোপাস। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিতর্কের কারণ কী?
বুদ্ধিমত্তার নিরিখে মানুষের পর উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীদের তালিকায় শীর্ষস্থানেই রয়েছে অক্টোপাস। শুধু বুদ্ধিমত্তাই নয়, অক্টোপাসকে অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রাণী বলেই চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। শারীরিক যন্ত্রণা, আনন্দ, দুঃখ, আবেগ অনুভব করতে পারে অক্টোপাস। এমনকি মানুষের মতো স্বপ্ন দেখতেও সক্ষম অমেরুদণ্ডী প্রাণীটি। যে জায়গায় হার মানে খোদ ডলফিনও। খাদ্যের জন্য এমন একটি প্রাণীর বাণিজ্যিক উৎপাদনকে নৈতিকতার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। পাশাপাশি কীভাবে উৎপাদিত হবে অক্টোপাস, কীভাবেই বা হত্যা করা হবে তাদের— সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য নিশ্চিত করে জানায়নি স্প্যানিশ সংস্থাটি। ফলে, থেকে যাচ্ছে সন্দেহের অবকাশ।
আরও পড়ুন
হাজার পা-ওয়ালা প্রাণী! এই প্রথম মিলল হদিশ
কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্ন যদি ওঠেই তবে গরু, ছাগল, মেষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীরাই বা বাদ থাকে কেন? গবেষকদের মতে, খাদ্যের জন্য যেকোনো প্রাণীর প্রতিপালনই নৈতিক নয়। তবে ইতিহাসের ধারা মেনেই তা পরিণত হয়েছে সভ্যতার দৈনন্দিন অভ্যাসে। চাইলেও তা বদলে ফেলার সুযোগ নেই। তবে মানবিকতার দিক থেকে দেখলে, নতুন করে খাদ্যের জন্য কোনো প্রাণীর চাষ শুরু করা আটকানোও অন্যতম কর্তব্য মানুষের। অন্যদিকে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু কিংবা শূকরের মতো প্রাণীদের গৃহপালন শুরু হয়েছে কয়েক হাজার বছর আগে থেকে। ফলে, তাদের সমস্ত চাহিদাও আমাদের কাছে অজানা নয়। কিন্তু অক্টোপাস সামুদ্রিক প্রাণী হওয়ায় এবং তাদের যাপনও গোপনীয় হওয়ায় কতটাই বা তাদের চাহিদা মেটাতে পারবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি? থেকে যাচ্ছে এই প্রশ্ন।
আরও পড়ুন
এক বছরে দাবানলে ১৭ মিলিয়ন প্রাণী মৃত আমাজনে
সাধারণত, গড়ে ৪ বছর বাঁচে অক্টোপাস। সেখানে ১ বছর বয়স হওয়ার পরই প্রতিপালিত অক্টোপাসদের পাঠানো হবে ফুড মার্কেটে। গবেষকদের হিসেব অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই তাদের বলি হতে হবে খাদ্যের জন্য। অন্যদিকে সাধারণত অক্টোপাস নিজের ওজনের প্রায় ৩ গুণ খাদ্য খেয়ে থাকে সারাদিনে। আর তা অধিকাংশটাই জীবিত মাছ এবং কাঁকড়া। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, অক্টোপাস প্রতিপালনের জন্য আশঙ্কাজনকভাবে প্রকৃতি থেকে হ্রাস পাবে মাছের সংখ্যা। প্রতিপালিত অক্টোপাসের খিদে মেটাতে এক ধাক্কায় বাড়বে সামুদ্রিক মৎস্যশিকারের পরিমাণ। সেভাবে সত্যিই কি সাম্যে পৌঁছাবে জীববৈচিত্রের সমীকরণ? প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে সেখানে। স্পেনে অক্টোপাস চাষের-এর প্রস্তুতি ধূমধাম করে শুরু হয়ে গেলেও, এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এখন দেখার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় আন্তর্জতিক সংস্থাটি…
আরও পড়ুন
উপকূলবর্তী প্রাণীদের ‘পরিবহন’-এর মাধ্যম হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক বর্জ্যই
Powered by Froala Editor