জুলস ভার্নের ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সিস’-এর কথা মনে পড়ে? আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে এই উপন্যাসে এক অদ্ভুত জলযানের সন্ধান দিয়েছিলেন বিশ্বের সর্বকালীন অন্যতম কল্পবিজ্ঞান লেখক। হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন নিমোর সেই ডুবোজাহাজের কথাই হচ্ছে। ‘নটিলাস’-খ্যাত সেই ডুবোজাহাজে চেপেই সাত সমুদ্রের তলায় ঘুরে বেড়াতেন প্রিন্স ডাক্কার ওরফে ক্যাপ্টেন নিমো।
শুধু কল্পবিজ্ঞানেই নয়, বাস্তবেও বিজ্ঞানের জগতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ‘নটিলাস’-এর (Nautilus) নাম। না, এটা অবশ্য ক্যাপ্টেন নিমোর সেই জাহাজ নয়। কথা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন ‘ইউএসএস নটিলাস’-কে নিয়ে। ক্যাপ্টেন নিমোর সেই নটিলাসের নামানুসারেই নাম রাখা হয়েছিল এই ডুবোজাহাজটির। উত্তর মেরুর বরফের তলায় একটানা ৭ দিন কাটিয়ে রীতিমতো নজির গড়েছিল ইউএস নেভির এই যানটি।
বলতে গেলে, একাধিক বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন জুলস ভার্ন। তবে ডুবোজাহাজের ধারণা তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতকেই। ব্রিটিশ গণিতবিদ উইলিয়াম বোর্ন প্রাথমিক নকশা তৈরি করেছিলেন এই যন্ত্রটির। ১৮ শতকে যা বাস্তবের রূপ পায়। ১৭৭৬ সালের রেভোলিউশনারি যুদ্ধে প্রথম ব্যবহৃতও হয়েছিল একক যাত্রীবাহী কচ্ছপ আকৃতির ডুবোজাহাজ। তবে ডুবোজাহাজের বৈশিষ্ট্যে সামান্য বদল এনেছিলেন ভার্ন। তাঁর গল্পে ক্যাপ্টেন নিমোর ডুবোজাহাজ জলের তলায় থাকতে পারত মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কিন্তু আদৌ কি বাস্তবে তা সম্ভব?
আজ থেকে ৭ দশক আগেও তা ছিল কল্পনামাত্র। আসলে সে-সময় সাধারণ যানবাহনের মতো ডিজেল, পেট্রোল কিংবা গ্যাসোলিনেই চলত সাবমেরিন। ফলে, জ্বালানির দহনের জন্য প্রয়োজন পড়ত অক্সিজেনের। একটানা তাই জলের তলায় কাটানো তাই অসম্ভব ছিল সমস্ত ডুবোজাহাজেরই। কয়েক ঘণ্টা ছাড়া ছাড়াই সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে পড়ত হত তাদের। শত্রুপক্ষের কাছে এইভাবে অবস্থান জানান দেওয়া নিরাপদ ছিল না কোনোদিক থেকেই।
এই সমস্যার সমাধান করতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই একাধিক গবেষণা শুরু হয়েছিল আমেরিকা, ইউরোপ এবং জাপানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শেষমেশ এই জটিল পাজল সমাধান করেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তনই সাফল্য এনে দেয় তাঁদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার শিখেছিল মানুষ। সেই শক্তিকেই মার্কিন গবেষকরা ব্যবহার করেন সাবমেরিনের ইঞ্জিন চালানোর জন্য।
১৯৫৪ সাল সেটা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৌজন্য প্রথম পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন প্রত্যক্ষ করে গোটা বিশ্ব। হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন নিমোর সেই ডুবোজাহাজের বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল এই প্রযুক্তি। তাই এই সমুদ্রযানের নামটাও রাখা হয় ‘ইউএসএস নটিলাস’।
তবে যুদ্ধযান তৈরিই তো শেষ কথা না। তার সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতাও পরীক্ষা করে দেখতে হয়। ১৯৫৮ সালের ৩ আগস্ট সেই উদ্দেশ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে সমুদ্রে নামানো হয়েছিল নটিলাসকে। দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল উইলিয়াম অ্যান্ডারসন। আদেশ ছিল এই সাবমেরিন নিয়ে তাঁকে অতিক্রম করতে হবে উত্তর মেরু। অর্থাৎ, বরফের চাদরের তলা দিয়ে পার করতে হবে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার পথ। যা তখনও পর্যন্ত একপ্রকার অসম্ভবই মানব সভ্যতার কাছে। অজানা সমুদ্রগর্ভে প্রতিপদেই লুকিয়ে রয়েছে মৃত্যুর সম্ভাবনা। তা সত্ত্বেও ১১৬ জন নাবিককে পাঠানো হয়েছিল ‘মিশন সানসাইন’-খ্যাত এই অভিযানে।
হ্যাঁ, সমস্ত বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত সূর্যের আলো দেখেছিল নটিলাস। তৈরি হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস। উত্তর মেরুর বরফের চাদরের তলায় ঢুকে পড়ার আগে গ্রিনল্যান্ডে প্রায় ৩ দিন জলের তলায় কাটিয়েছিলেন নটিলাসের নাবিকরা। মানিয়ে নিয়েছিলেন এই অত্যাধুনিক নতুন যন্ত্রের সঙ্গে। তারপর শুরু হয়েছিল অভিযান। ৭ দিনে সাড়ে ছশো মাইল পথ অতিক্রম করে ভেসে উঠেছিল নটিলাস। বিশ্বের দীর্ঘতম ‘ডাইভিং’ হিসাবে সেসময় চিহ্নিত করা হয়েছিল নটিলাসের এই কীর্তিকে। তবে এখানেই শেষ নয়, নটিলাস এর পরেও একাধিকবার অভিযান করেছে উত্তর মেরুর বরফের নিচে। কখনও ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বুকে ত্রাস সঞ্চার করতে, কখনও আবার বৈজ্ঞানিক স্বার্থে। নটিলাসের সৌজন্যেই প্রথমবারের জন্য নির্ণীত হয়েছিল উত্তর মেরুর বরফের চাদরের গভীরতা এবং আয়তন। সবমিলিয়ে নটিলাসের কীর্তি এককথায় বদলে দিয়েছিল সামরিক বিজ্ঞানের গতিপথ। তাছাড়াও পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের দৌলতেই পরবর্তীতে সন্ধান মেলে উত্তর মেরুর সমুদ্রগর্ভের রহস্যময় বাস্তুতন্ত্রের। সেদিক থেকে নটিলাসের অভিযানকে ঐতিহাসিক না বলে উপায়ই বা কী?
Powered by Froala Editor