পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের পাঁচের পল্লির মণ্ডপ পেরিয়েই প্রকাণ্ড এক রাজবাড়ি। হ্যাঁ, এই বাড়ি কিংবদন্তি বঙ্গব্যক্তিত্ব মন্মথনাথ ঘোষের। যে বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এর। সেখানেই বসেছে সংস্কৃতির আসর। ভিড় করেছেন হাজার হাজার মানুষ। পণ্ডিত বিলায়েত খান, ভীমসেন যোশী, রবিশঙ্কর, উস্তাদ আমির খান— কে নেই সেখানে? এমন সময় তারকাখচিত এই মঞ্চে হাজির হলেন এক বছর চোদ্দো-র কিশোর। কথক নৃত্য প্রদর্শন করবে সে। এর আগে তার নাম শোনেনি কেউ-ই। তাঁর নৃত্য পরিবেশনও দেখেননি কেউ। এমন এক আনকোরা শিল্পীকে এমন মঞ্চে জায়গা দিলেন আয়োজকরা! গুঞ্জন উঠল দর্শক মহলে…
সেটা ১৯৫২ সাল। আজ থেকে প্রায় সাত দশক আগের কথা। প্রথমবারের জন্য মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শনী করেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, চতুর্দশবর্ষীয় ওই কিশোরই পণ্ডিত বিরজু মহারাজ (Birju Maharaj)। হিসেব মতো দেখতে গেলে বিরজু মহারাজ মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করেছেন মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই। কিন্তু তা ছিল পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আনুষ্ঠানিকভাবে পেশাদার শিল্পী হিসাবে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল এই কলকাতার বুকেই। ঘোষবাড়িতে। সেই প্রদর্শনীকে কঠিনতম পরীক্ষা বললেও ভুল হয় না এতটুকু। এক তো কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের সামনে নৃত্য পরিবেশনের চাপ, দ্বিতীয়ত জনরোষ। তবে সেদিন গোটা কলকাতা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর লয়ের ঝংকারে।
অথচ, কলকাতার বুকে তাঁর এসে পড়া ছিল খানিকটা আকস্মিকই। এমন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভারতের কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পীদের ডাক পড়বে না তা কি হতে পারে? স্বাভাবিকভাবেই চিঠি পৌঁছেছিল লখনৌয়ের মহারাজ পরিবারে। লখনৌ ঘরানার কথক নৃত্যের ধারক ও বাহক যে পরিবার। যেখান থেকে উঠে এসেছে অচ্ছন মহারাজ, শম্ভু মহারাজ, লচ্ছু মহারাজের মতো তারকা।
তবে সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। পণ্ডিত লচ্ছুজি তখন কোরিওগ্রাফির কাজে ব্যস্ত বোম্বে নগরীতে। অন্যদিকে ওই একইদিনে লখনৌতে অন্য একটি প্রদর্শনীর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছেন শম্ভু মহারাজ। পত্রপাঠ তিনি জানিয়ে দিলেন সে-কথা। তবে কলকাতার এমন নামকরা মঞ্চে কি আলো ফুটবে না লখনৌয়ি কথকের? না, ঠিক হল তাঁর হয়ে কলকাতায় সেদিন হাজির হবে তাঁর ভাইপো বিরজু। কৈশোরের গণ্ডি না পেরলেও, নৃত্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অন্যদিকে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কিশোর বিরজু মহারাজও। কাকার প্রস্তাব পেয়ে একবাক্যেই রাজি হয়ে গেলেন তিনি। তারপরই সেই কঠিন পরীক্ষা।
আরও পড়ুন
দেশের দ্বিতীয় রূপান্তরকামী হিসাবে পদ্মশ্রী পেলেন কর্ণাটকের যোগাপ্পা নৃত্যশিল্পী
ঘোষবাড়িতে সেদিন নৃত্যানুষ্ঠান শুরু হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত হয়ে গিয়েছিল গোটা মহলের পরিবেশ। টানা আড়াই ঘণ্টা বাকরুদ্ধ হয়ে নিস্পলক চোখে সেই অনুষ্ঠান দেখেছিলেন দর্শকরা। প্রত্যক্ষ করেছিলেন এক কিংবদন্তির উত্থানের জন্মলগ্ন। মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল ফুটপাথেও। নৃত্য না দেখতে পেলেও, শুধু ঘুঙুরের ঝংকার শুনতে ফুটপাথেই জায়গা করে নিয়েছিলেন বহু মানুষ।
আরও পড়ুন
ঈশ্বর তোমাকে নৃত্যের জন্যই গড়েছেন
আর বিরজু মহারাজ? কলকাতার সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতাতেই জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে পেয়েছিলেন এক অবিস্মরণীয় খেতাব। ‘লয়ের পুতুল’। যে উপাধি তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
আরও পড়ুন
নৃত্য সেদিন পেরিয়ে গেল মঞ্চের সীমা
কলকাতার সঙ্গে এভাবেই এক আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বিরজু মহারাজের। জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত অক্ষত ছিল যে সুতোর টান। কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে একাধিকবার হাজির হয়েছেন বিরজু পণ্ডিত। শেষ বয়সেও নৃত্য পরিবেশন করেছেন কলাভবনে। রবিশঙ্করের সঙ্গে আলোকিত করেছেন একই মঞ্চ। আবার সত্যজিতের চলচ্চিত্রে কোরিওগ্রাফি কিংবা গানেও মেলে ধরেছেন নিজেকে। কলকাতায় শ্যুটিং মানেই তাঁর কাছে ছিল মিষ্টি দই আর রায়বাড়ির আড্ডা। কলকাতাতেও তাঁর এক ভিন্ন পরিবার রয়েছে, সে-কথা নিজেও স্বীকার করেছিলেন বিরজু মহারাজ।
আজ ৮২ বছর বয়সে চিরঘুমের জগতে পাড়ি দিলেন তিনি। কলকাতার সঙ্গে লখনৌয়ের যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক কিংবা আত্মীয়তার যোগ রয়েছে কয়েক শতক ধরে— এমন এক ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়ায় যেন আলগা হল সেই সুতোর টান। কলকাতা হারাল তাঁর নিজের এক অভিভাবককে। যে ক্ষতি অপূরণীয়…
তথ্যসূত্রঃ আমার জন্ম হোক সেটা আমার মা চাননি, সাক্ষাৎকার, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor