গুলাবি গ্যাং না বলে বলা ভালো ‘ব্লু গ্যাং’। কিন্তু দাপট সেই একই। শুধু পরিবেশ আর পরিস্থিতি আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল। শুধু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই নয়, গোটা ক্রিকেট মরসুমেই তাঁদের ‘দাদাগিরি’ অব্যাহত ছিল। কেউ এসেছেন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে, কেউ বা পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে। লক্ষ্য একটাই, ২২ গজে ভারতকে সেরা জায়গাটা দেওয়ার। এই বিশ্বকাপেই উঠে এসেছে দুই তরুণীর নাম— শেফালি বর্মা আর রাধা যাদব। এদেরকে নিয়েই আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সবাই।
শেফালির কথাই ধরা যাক। বয়স মাত্র ১৬। এই বয়সে আমরা অনেকেই নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে ভাবতাম, আর অন্য কিছুর দিকে তাকানোরও সময় হত না হয়তো। এই বয়সেই শেফালি নিজেকে বিশ্বসেরার উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত মহিলাদের আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে উঠে এসেছেন এই ভারতীয় ওপেনার। এর আগে এত কম বয়সে এই স্বীকৃতি পাননি কেউ! অস্ট্রেলিয়ায় দুরন্ত ফর্মে রয়েছেন শেফালি। সামনে যাকেই পেয়েছেন, স্রেফ উড়িয়েছেন। এখনও অবধি তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৬১! বাবা ছিলেন স্বর্ণকার। ১২ বছর বয়সে প্র্যাকটিস শুরু; কিন্তু অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সমস্ত টেকনিক শিখে নেন। আজ আজ? টিভি খুললেই তাঁর ওপেনিং ব্যাটে ভরসা রাখে আপামর বাঙালি।
আরও পড়ুন
জাতীয় স্তরে খেলার মুখেই আক্রান্ত ক্যানসারে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই ১৭ বছরের রাইফেল শুটারের
অন্যদিকে, ২২৫ স্কোয়ার ফুটের একটি ঘর। মুম্বইয়ের কান্দিভালিতে বেড়ে উঠছিল একটি মেয়ে। খেলার বড়ো ইচ্ছা, বিশেষ করে ক্রিকেট। টেনিস বলেই চলত প্র্যাকটিস। ব্যস, ওইটুকুই। সেটাই একদিন দেখে ফেলেন প্রফুল্ল প্যাটেল। অভিজ্ঞ কোচ বুঝতে পারেন, মেয়েটির প্রতিভা আছে। একে খেলাতে হবে। কিন্তু বাড়ির অবস্থা তো অত্যন্ত খারাপ। এরই মধ্যে একদিন মেয়েটি গেল শিবসেনা ময়দানে। সেখানে লাইন দিয়ে মেয়েরা খেলছে। সেই থেকে শুরু রাধা যাদবের স্বপ্নের। ক্রিকেটার হওয়ার, ভারতের জার্সি গায়ে চাপানোর।
ভারতের মহিলা ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তি মিতালি রাজ এবং ঝুলন গোস্বামী। প্রথমে তাঁদেরকে সেরকমভাবে চিনতেন না বলেই একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন রাধা। প্রফুল্ল প্যাটেল কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তাঁকে ট্রেনিং দিতে থাকেন। এমন সময় ২০১১ সালে ভারতের পুরুষ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ জেতে। গোটা ভারতের অনেক ক্রিকেট শিক্ষার্থীর মতো রাধাও স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তাঁর স্বপ্নের সাক্ষী থাকে বাবা, মা আর তাঁর দিদি। উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা হয়েও স্রেফ দুটো টাকার জন্য সপরিবারে মুম্বই চলে আসা। দুধ বিক্রি করে সংসার চলত তাদের। রাধা আর তাঁর দিদি সোনি দুজনেই ক্রিকেট খেলতেন। কিন্তু বোনের ক্রিকেটের প্রতি প্যাশন, উৎসাহ দেখে তিনিও খেলা ছেড়ে দেন। বোন যাতে ভালোভাবে খেলতে পারে, সেই চেষ্টাই করতেন তিনি। আজও করেন।
আরও পড়ুন
অভাব ঠেকাতে করেছেন রান্নার চাকরিও, জাতীয় স্তরে সোনা নদীয়ার মেয়ের
তারই প্রতিফলন দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের প্রথম দুটি ম্যাচে সুযোগ পাননি। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুযোগ পেয়ে ২৫ রান দিয়ে একটি উইকেট নেন। তার পরের ম্যাচেই কেল্লাফতে! শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৩ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন তিনি; যা কিনা এই টুর্নামেন্টে রাধা যাদবের সেরা ফিগার। ৩৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৪৮টি উইকেটও নিয়েছেন তিনি। প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও লড়ে গেছেন তিনি। শুধু রাধা নয়, তাঁর পরিবারও সেই লড়াইয়ের সামিল। ঘরে, সমাজে, ক্রিকেটের রণক্ষেত্রে যা চলেছে সমান তালে। সেখানেই উঠে আসছেন শেফালি, রাধারা।