শতবর্ষের ধর্মশালা থেকে শহরের প্রথম পার্সি ক্যাটারিং – ভোজনরসিকদের ‘অন্য’ কলকাতা

৯ নম্বর বো স্ট্রিট। বো-ব্যারাকের গলিটা শেষ হয়ে ধাক্কা খাচ্ছে একটা পেল্লায় বাড়িতে। বাড়ির উপরে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা, ‘মানাকজি রুস্তমজি ধর্মশালা ফর পার্সি ট্র্যাভেলার্স’। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ধর্মশালার বয়স ১০০-র কিঞ্চিৎ বেশি। ১৯০৯ সালে মানাকজি রুস্তমজি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন ধর্মশালা। মুম্বই, আহমেদাবাদ থেকে পার্সিদের অনেকেই কলকাতায় এলে উঠতেন এই এখানে। থাকা-খাওয়ার খরচ ছিল যৎসামান্যই…

স্টিলের ফটক ঠেলে ঢুকতেই ছুটে আসেন দারোয়ান। দুপুর দু'টো বেজে দু'মিনিট। শুনশান বো-ব্যারাক। বড়দিনের ক্রিসমাস ট্রি অগোছালো পড়ে রাস্তার ধারে। উপরে তাকিয়ে দেখলাম জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে বলিরেখাভরা, কয়েকটি মুখ।

মন ইতস্তত করে…

‘কেয়া চাহিয়ে?’ 

থতমত খেয়ে বলি ‘ম্যানেজার সাব হ্যায়?’

তারপর দ্বাররক্ষীর পেছন পেছন চলে আসি ম্যানেজারবাবুর ঘরে। ঘরে কেউ নেই। ‘ম্যানেজার সাব’ খেতে গিয়েছেন বোধহয়। উশখুশ করতে থাকি আমি…

আরও পড়ুন
বায়ুমণ্ডলের গুণমান নেমে এল ‘আশঙ্কাজনক’ স্তরে, সিঁদুরে মেঘ কলকাতায়

‘ওয়েল, ওয়াই আর ইউ হিয়ার?’

সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। চশমার ফাঁক দিয়ে জরিপ করেন আমায়। ‘ইউ আর এ রাইটার? সো ওয়াট ডু য়ু ওয়ান্ট টু রাইট এবাউট?' 

আলাপ জমে ওঠে ধীরে ধীরে।

আরও পড়ুন
কলকাতায় এলেন গালিব, তর্কে জড়ালেন অন্যান্য কবিদের সঙ্গেও

ভদ্রমহিলার নাম মেহের হানসোটিয়া। জন্মসূত্রে পার্সি। ২০১৩ সালে তিনি আর তাঁর স্বামী দারা আহমেদাবাদ থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। এই ধর্মশালার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে। নির্ঝঞ্ঝাট-নিঃসঙ্গ জীবন। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। এই বিশাল বাড়ির ভার নেওয়া চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু তারপরেও হাতে পড়ে থাকে অখণ্ড অবসর। কাটতে চায় না সময়। তাই স্বামী-স্ত্রী ঠিক করলেন ব্যবসা শুরু করবেন…

কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন প্রায় ৪০০ জন পার্সি। বহু পরিবারের সঙ্গেই মেলামেশা রয়েছে দারা-মেহেরের। মাঝে মাঝেই পার্টি হয় ধর্মশালায়। যাঁরা আসেন, প্রত্যেকে হয়ে যান মেহেরের রান্নার ভক্ত। তাছাড়া সারা কলকাতায় পার্সি খাবার দাবার কোনো রেস্তোরাঁতেই সেভাবে পাওয়া মেলে না…

আরও পড়ুন
উৎসবের মেজাজ ফিকে, ক্রিসমাসের আগের দিনেও বিষণ্ণ কলকাতার অ্যাংলো-পাড়া

তাই খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই মেহের আর দারা খুলে ফেলেছেন ‘মেহের ক্যাটারার্স’। আর খুলেই হিট। এখানে শুধুই পাওয়া যায় পার্সি খাবার-দাবার। মেহের নিজেই রাঁধেন। সাহায্য করার জন্য রয়েছে দু'জন। ক্যাটারারের অন্য সমস্ত দ্বায়িত্ব সামলান দারা। 

‘আপনারাই তাহলে কলকাতায় প্রথম পার্সি ক্যাটারার?’

‘তা বলতে পারো।' হাসলেন মেহের। 

দারাও যোগ দিয়েছেন গল্পে। ধর্মশালার এককোণে খাবার জায়গা। সেখানে জনা কুড়ি বসে খেতে পারে। এছাড়া বউ বাজার এলাকায় ডেলিভারি যায় মেহেরের খাবার। ফোন করে অর্ডার দিলেই হল। ক্রিসমাস ও নববর্ষেও নতুন মেনু। তবে এই ক্যাটারারের ‘স্টার ডিশ’ হল ‘সাল্লি চিকেন কারি’।

‘সেটা কী বস্তু!’ পার্সি রান্না নিয়ে আমার অজ্ঞতা বেরিয়ে পড়ে অচিরেই। 

‘চিকেন কারির ওপর আলুর ছোটো ছোটো ভাজা ছড়িয়ে দেওয়া। মশলাও আলাদা। না খেলে বুঝতে পারবে না!’

নতুন বছরের মেনুতে মেহেররা রাখছেন, কিমার প্যাটিশ, প্ৰণ পেশিও, মাটন পুলাও ডালের মতো লোভনীয় খানা...

ভাবছি, পয়লা জানুয়ারি হানা দেব চেখে দেখতে।

Powered by Froala Editor

Latest News See More