মাত্র এগারো বছর হল এসেছে স্বাধীনতা, অথবা দেশভাগ। যে নামেই ডাকা হোক, মানুষের জীবনে তখনও কোনো ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি এই ঘটনা। ইংরেজ শাসকদের জায়গা নিয়েছেন দেশের নেতারা। কিন্তু মানুষের দুঃখ দুর্দশার চেহারাটা প্রায় একই থেকে গিয়েছে। একই থেকে গিয়েছে পদ্মা নদীর মাঝিদের গল্পও। হ্যাঁ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই মাঝিরা। কুবের, কপিলা, হোসেন মিয়াদের জীবনে স্বাধীনতার স্বাদ এসে পৌঁছয়নি তখনও।
১৯৩৬ সালের সেই উপন্যাসকেই নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেন ২২ বছর পরের শিল্পীরা। আখতার জং কারদারের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেল 'জাগো হুয়া সাভেরা'। পাকিস্থানের সিনেমাগুলির মধ্যে এটিই প্রথম অস্কারের জন্য মনোনয়ন তালিকায় স্থান পেয়েছিল। এছাড়াও মস্কো আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল এই সিনেমা। তবে এখানেই শেষ নয়। এই সিনেমার প্রাপ্তির তালিকায় আছে অসংখ্য বিতর্ক, হারানো ও প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস।
২০১৬ সালে মুম্বই চলচ্চিত্র উৎসবে এই সিনেমার প্রদর্শনকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। একদলের দাবি ছিল, পাকিস্তানের কোনো সিনেমা প্রদর্শন করা যাবে না। অবশ্য শিল্পের কোনো দেশকাল থাকে না, এমন কথা বলেন অনেকেই। 'জাগো হুয়া সাভেরা' বোধহয় দেশ এবং কাল দুই দিকই অতিক্রম করতে পেরেছিল। অবশ্য দেশভাগের পর খুব বেশি সময় তখনও কাটেনি। দুই দেশের শিল্পীদের নিবিড় যোগাযোগ তখনও অক্ষুণ্ণ থেকেছে। আর তাই হয়তো এমন একটি সিনেমা সৃষ্টি হয়েছিল।
সিনেমার গল্প পূর্ব পাকিস্তানের মুন্সীগঞ্জের পদ্মাপাড়ের। অভিনয় হয়েছে সেখানেই। আর পরিচালনা করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের জং কারদার। চিত্রনাট্য লিখলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ। তিনিও সেই অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ। আবার সহকারী পরিচালক জহির রায়হান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। সেইসঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের সেরা কুশীলবরা একযোগে তৈরি করলেন এই সিনেমা। পাকিস্তানের অভিনেতা আতাউর রহমান আর কাজি খালেকের সঙ্গে অভিনয় করলেন কলকাতার অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। সঙ্গীত পরিচালনা করলেন তিমির বরণ। আর সাদা কালো ক্যামেরায় সমস্ত দৃশ্য ধরলেন ওয়াল্টার লাসালি। তাই কোনো নির্দিষ্ট দেশের সিনেমা বললে একটু ভুল হবে এক্ষেত্রে।
ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত সিনেমার তালিকা তৈরি করলে তার মধ্যে 'জাগো হুয়া সাভেরা'র নাম থাকবে নিশ্চই। ১৯৫৯ সালে মুক্তির ঠিক তিনদিন আগে সিনেমাটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করল আইয়ুব খান সরকার। কারণ এতে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার বীজ আছে। গত্যন্তর না দেখে সিনেমাটি মুক্তি পেল ইংল্যান্ডে। অবশ্য উর্দু ভাষার এই সিনেমা সেখানে বেশিদিন চলেনি। ক্রমশ সিনেমার সমস্ত রিলও হারিয়ে যায়।
প্রযোজক নৌমান তাসিরের ছেলে আনজুম তাসির ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো অংশগুলো জড়ো করেন ২০০৭ সালে। তারপর সেগুলো থেকে আবার উদ্ধার করা হয় একদা ইতিহাস তৈরি করা এই সিনেমা। ২০১৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে আবার প্রদর্শিত হয় 'জাগো হুয়া সাভেরা'। তবে বিতর্ক হয়তো এই সিনেমার পিছু ছাড়বে না। সেই বছরই মুম্বই চলচ্চিত্র উৎসবের তালিকা থেকে বাদ গেল সিনেমাটির নাম। পাকিস্তানের সরকারের কাছে এই সিনেমা ছিল আতঙ্কের কারণ। আর ভারতের কাছে?
Powered by Froala Editor