আলু নিয়ে আলোচনা, নেপথ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক আলু দিবস

২০০৫। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির। রাতের খাওয়া সেরে বিনয় ভবনে ফেরার সময় উঁচু ক্লাসের এক দাদা বলেছিল, 'ব্রহ্মময় জগত আর আলুময় বিদ্যামন্দির'। কথাটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলাম আলু ছাড়া হোস্টেলের খাওয়া অচল। মনে ব্যাজার থাকলেও মুখে হাসি লেপ্টে যেটা খাওয়া যায় সেটা আলুই। আচ্ছা, নির্বাচনের গরম হাওয়ায় আলুকে গণতান্ত্রিক সবজি বলা যেতে পারে কি? চিন্তা করবেন না, আলুকে প্রতীক করে নির্বাচনে লড়ার কোনো প্রয়োজনই এদেশের কোনো নেতার নেই। দেখতে তো আহামরি নয়! তবে,বাঙালির এমন কোনো রান্নাঘর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আলুর উপস্থিতি নেই। মাছ থেকে মাংস তরকারি যা-ই হোক, তাতে আলু বিরাজমান। সর্বত্রই সবার সঙ্গে আলু সহজে মিশে যায়। তাতে হাসিমুখে আপনি মেনে নিলেও এই অতি সহজে মিশে যাওয়াটা বড্ড তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে স্বয়ং আলুরই কাছে। 

    মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বোঝাতে আলু নিয়ে একটি  প্রবাদ আছে, ‘ঘর পোড়ার মাঝে আসছে আলু পোড়া দিতে।’ হ্যাঁ, চারপাশে তাকালে অবশ্য এমন মানুষ দেখা যায় যে অন্যের বিপদগ্রস্ত অবস্থা ব্যবহার করে কেউ কেউ সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেয়। আর ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’—বিশেষ সময়ে চালু হওয়া এই লাইন তো সর্বজনবিদিত। 

   তবে শুধু আলুকেই কেন্দ্র করে রয়েছে নানা পদের মুখরোচক খাবার। আলুর চপ থেকে আলুর চিপস! বর্ষার খিচুড়ির সঙ্গীও এই আলু ভাজা। তবে, গেরস্থের হেঁসেলের গণ্ডি পেরোলেই এই আলু ভাজার ফিগার হয়ে ওঠে স্লিম-অ্যান্ড-ট্রিম। তাই দেশের সকল অভিজাত হোটেলে আলু দিয়ে তৈরি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই জনপ্রিয়। 

  তবে, আলু আজকের ফসল না। বিজ্ঞানীদের মতে,  প্রথম আলুর উদ্ভব যেটা হয়েছিল, সেটা বুনো আলুর এবং দক্ষিণ আমেরিকার দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রথম আলুর চাষ শুরু হয়। এটা প্রথমে ছিল ফুলের গাছ। আন্দিজ পর্বতমালার, মানে এখন যেটা দক্ষিণ পেরু এবং উত্তর-পশ্চিম বলিভিয়া সেখানে প্রথম আলু সার্থকভাবে চাষ করা হয়। তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে আলু চাষ চালু হবার কয়েক শতাব্দী পর আলু হয়ে উঠল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে রিভল‍্যুশনারি যুদ্ধ শুরু হলে দেখা দিল খাদ্য সংকট। জনগণ বাধ্য হল খাবার টেবিলে আলু রাখতে। তখন ইংল্যান্ডের তৎকালীন বোর্ড অব এগ্রিকালচার আলু চাষের নিয়মকানুন নিয়ে প্রচার করতে শুরু করে।

  এটা শুধু ইংল্যান্ড নয়, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সেও ঘটেছিল। সেই সময়কার সৈন্যরা যখন খাবারের খোঁজে কৃষকের মাঠ লুঠ করত তখন তারা গম, আঙুর এসব লুঠ করত। আলু যেহেতু মাটির নিচে হবার জন্য ওরা এগুলো কেটে নিয়ে যেত না। কৃষকরা দেখল খুব সুবিধা, কারণ আলু আছে নিরাপদে। তা সত্ত্বেও তখন আলু চাষে খুব যে অগ্রগতি এসেছে এমনটা নয়। উচ্চবিত্তের ধারণা আলু দেখতে বাজে বলে খেলে হয়তো অসুখ হতে পারে। ১৭৭১ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হল আলু চাষের জন্য। ষোড়শ লুই মানুষের মন থেকে আলুর সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করার জন্য জামার বোতামে আলুর ফুল লাগিয়ে এলেন। রানি মেরি এন্টোনিও চুলের খোঁপায় পাইন করে রাখলেন আলুর গোলাপি ফুল। প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডেরিকও চেষ্টা করেছিলেন তার রাজ্যের লোকেদের আলু খাওয়াতে, কিন্তু পারেননি। কারণ ওই বিস্বাদ, গন্ধহীন আলু কে ই-বা মুখে তুলবে! রাজার তখন মহাবিপদ। কারণ, একদিকে খাদ্য সংকট চলছে, গমের দাম বাড়ছে হু-হু করে, তখন রাজা বুদ্ধি আঁটলেন। লোকজনের উপর রাজা প্রয়োগ করলেন উল্টো সাইকোলজি। তিনি ঘোষণা করলেন, তাঁর রাজকীয় বাগানে তিনি আলু চাষ করবেন এবং কোনো আলু সেখান থেকে চুরি করা যাবে না। সবাই জানে নিষিদ্ধ বস্তুর উপর আকর্ষণ বেশি। লোকজন ওই বাগান থেকে দিব্বি আলু চুরি করতে লাগল। চুরি করে আলু গাছ নিজেদের বাগানে লাগিয়ে দিল কৃষকরা। গার্ড ছিল, তবে সেটা না থাকার মতনই। রাজার উদ্দেশ্য সফল হল। তিনি তো এটাই চেয়েছিলেন! এমনকি তার নামও হয়েছিল 'পটেটো কিং'। তবে বর্তমানে আলু কিন্তু রাজনীতির গন্ধও পেয়েছে, ২০০৫ সালেই রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই আইভানভ বলেছিলেন, গণতন্ত্র আলু নয় যে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে নিয়ে লাগাবেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জাম্বিয়ার প্রধান বিরোধী দলের নেতা ফ্রাঙ্ক বোয়ালিয়া সে দেশের প্রেসিডেন্ট মাইকেল সাটাকে মিষ্টি আলু বলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডযোগ্য এবং জামিনঅযোগ্য একটি অপরাধ করে গ্রেপ্তার পর্যন্ত হয়েছিলেন। 

   ভারতে আলুর আগমন হয় ১৭ এর শতকের প্রথম দিকে, পর্তুগিজদের হাত ধরে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপকূলের ধারে সুরাটে প্রথম আলুর চাষ শুরু হয়। সেখান থেকেই এটি পর্তুগিজ উপনিবেশ হিসেবে পরিচিত হয় গোয়াতে প্রথম এবং পরে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে, পালযুগের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিত'-এ বারাহী কন্দের উল্লেখ আছে। এই বারাহী কন্দই উচ্চমানের আলু।

  আলু নিয়ে রবি ঠাকুরেরও একটা মজাদার গল্প আছে। জমিদার হিসেবে বিচারব্যবস্থায় যত সফলই হোন না কেন, এটাও সত্য যে চাষি হিসেবে চূড়ান্ত আনাড়িপনার পরিচয় দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবশ্য চাষ তিনি জীবনে একবারই করেছিলেন, তা-ও সেটা নিজ হাতে নয়, করিয়েছিলেন লোকজন দিয়ে। বিখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তখন ছিলেন কুষ্টিয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি আবার রবীন্দ্রনাথের বন্ধুও। প্রায়ই গড়াই নদী পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে তিনি হাজির হতেন দু-এক দিনের অতিথি হয়ে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বিশাল এক বাগান করেছেন। সেই বাগান দেখেই জেগে উঠল দ্বিজেন্দ্রলালের কৃষিবিদ সত্তা। দ্বিজেন্দ্রলাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিলেতে গিয়েছিলেন কৃষিবিদ হতে। পড়াশোনা শেষ করে ফিরেও এলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তখনো ভারতে কৃষি-প্রশাসন গড়ে তুলতে পারেনি। তাই দ্বিজেন্দ্রলাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথের বাগান দেখে তিনি তাঁকে বাগানের এক কোনায় গোল আলু চাষের পরামর্শ দেন। এ দেশে সে সময় গোল আলুর চাষ সেভাবে শুরু হয়নি। তবু শিলাইদহের কয়েকজন চাষি আলুর চাষ করতেন। তাঁদের মধ্য থেকে রবীন্দ্রনাথ এক চাষিকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কাছ থেকে আলুর বীজ নিয়ে সেগুলো বপন করলেন দ্বিজেন্দ্রলালের ফর্মুলা অনুযায়ী। তখন ওই চাষি বললেন, ‘করছেন কী মশাই! এভাবে আলু লাগলে তো মাঠে মারা যাবে চাষ!’ রবীন্দ্রনাথের তখন অবস্থা খারাপ—একদিকে অভিজ্ঞ চাষি, অন্যদিকে ডিগ্রিধারী কৃষিবিদ বন্ধু—কার কথা শুনবেন?

  শেষমেশ দ্বিজেন্দ্রলালের পরামর্শ মতোই লাগানো হলে আলু। এরপর দেখা গেল, রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ আলুর বীজ বপন করেছিলেন, সেটাই ফিরে আসেনি। সুতরাং চিরতরে সমাধি ঘটল আলুচাষি রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু নিজের ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা নিয়েই পড়তে। নোবেল পাবার আগে প্রথমবার রবি ঠাকুর আমেরিকা সফর করেন ১৯১২ সালে। রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ তখন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এস.সি কৃষির ছাত্র। বাবার মতপই তাঁর সাহিত্য নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। অক্সফোর্ড অথবা লন্ডনের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও তার বাবার ইচ্ছায় রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় কৃষি নিয়ে লেখাপড়া করেন। রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে আলু চাষ শিখে আসেন। পাবনার পতিসর ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহ অঞ্চলের কৃষকদের আলুর বীজ সরবরাহ করে আলু চাষ পদ্ধতি শেখানোর কথা বহুল প্রচারিত।

  শুধু আলু নয়, রীতিমতো আলুর দম নিয়ে মেলা হয় এই পশ্চিমবঙ্গে। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের কাছাকাছি রাজাপুর এ মাঘ মাসের প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয় আলুর দমের মেলা। একেবারে নিরামিষ আলুর দম। হলুদ, লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে সেদ্ধ আলু। দাম একই। মাঘের শীত বাঘের গায়ে দিয়েই দলে দলে মানুষের ভিড়। শুধু হাওড়া নয়, হুগলির জাঙ্গিপাড়ার রাজবলহাটের জান্দা এলাকাতেও বসে আলুর দমের মেলা। নতুন ধান ওঠার আনন্দে যেমন পিঠে পার্বণ পালিত হয়, তেমনই নদীর তীরে চাষ হয় আলু। আলুর দমের মেলা সেই নতুন আলু ওঠার উদযাপন। হাওড়া, হুগলির মতোই মালদার বিভিন্ন অঞ্চলেও মকর সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে এই আলুর দমের মেলা বসে। মহানন্দার পাড়ে যে সব গ্রামে আলু চাষ করা হয়, সেখানে এই আলুর দমের মেলাও লক্ষ্য করা যায়।

  বিরিয়ানিতে আলুও কিন্তু কম জনপ্রিয় নয়। ১৮৫৬ সালের ৬ মে কলকাতায় পৌঁছান নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এই ওয়াজিদ আলির জন্যই কলকাতা বিরিয়ানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তাঁর রসনা তৃপ্তির জন্যই এ শহরে ‘দমপোখ্‌ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না শুরু হয়। বিরিয়ানিতে হাল্কা গন্ধওয়ালা হলদেটে আলু আর ধবধবে সাদা ডিমের উপস্থিতি ছিল না প্রথম থেকে ৷ এর প্রচলনটাও কিন্তু ভারী অদ্ভুতভাবে শুরু করেছিলেন নবাব। ওয়াজিদ আলি শাহ যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁর কাছে তেমন অর্থ ছিল না৷ তবে নবাবিয়ানাটা তো রক্তে৷ তিনি ছিলেন, ‘খানে কা অউর খিলানে কা শওখিন’৷ খেতে এবং খাওয়াতে দারুণ পছন্দ করতেন তিনি৷

  তবে শোনা যায়, সে সময় আলুর দাম কিন্তু এত কম ছিল না! পর্তুগিজরা এ দেশে নিয়ে আসে আলু ৷ এদিকে মাংসের দাম এত বেশি! বিপুল পরিমাণে মাংস কিনে বিরিয়ানি তৈরি করার ব্যয়ভারটা কিন্তু সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই৷ সেই কারণে কিছুটা খরচ বাঁচাতে, এরই সঙ্গে বিরিয়ানির সঙ্গে আলুর ব্যবহার শুরু হয় ৷ ওয়াজিদ আলি শাহ-র সেই বিরিয়ানির ধারা বহমান তাঁর প্রপৌত্রী মনজিলাত ফতিমার তৈরি বিরিয়ানি প্রস্তুতে। প্রতিবার বিরিয়ানির হাঁড়ি চাপানোর আগে উচ্চারিত হয়— ‘বিশমিল্লাহ’৷ আল্লাহ’র নাম নিয়ে শুরু হয় রান্না৷ হাতের জাদুতে শুরু হয় বিরিয়ানি তৈরি। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দম-এ বিরিয়ানি তৈরি৷ দম-এ বিরিয়ানি তৈরি হওয়ার সময় নিজে তো কোনও কথা বলেনই না, কাউকে কথা বলতেও দেন না মনজিলাত৷

  সময় পেরিয়ে এসেছে অনেক। ৩০ শে মে, ২০২৪ এই দিনটিতে জাতিসংঘের FAO (Food and Agriculture Organization of the United Nations) আন্তর্জাতিক আলু দিবস উপলক্ষে একটি বিস্তৃত নির্দেশিকা চালু করেছে,  যার থিম 'হার্ভেস্টিং ডাইভার্সিটি, ফিডিং হোপ।' এই দিনটির লক্ষ্য কৃষি খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং পরিবেশগত অসুবিধার মোকাবেলায় আলুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা। FAO-এর একজন কৃষিবিদ মাকিকো তাগুচি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং আলু চিপসের মতো সাধারণভাবে যুক্ত আইটেমগুলির বাইরেও আলু খাওয়ার স্বাস্থ্যকর পদ্ধতির প্রচারের গুরুত্বের উপরও জোর দেবার কথা বলেন। তবে, জোর দিলেই সেটা সফল হবে, তা বলা যায় না। প্রথম আন্তর্জাতিক আলু দিবসে কি মানুষরা আলু নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হুড়োহুড়ি করবে নাকি আলু বলেই সে থেকে যাবে ব্রাত্য! সময়ই বলবে সে-কথা…

Powered by Froala Editor

Latest News See More