বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ ছাত্র আপনি। ঘরে বসে আপনমনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন। হঠাৎই তৈরি করে ফেললেন অদ্ভুত একটি জিনিস। এমন যন্ত্র যা এর আগে কখনও তৈরি হয়নি। এমন যন্ত্র হয়তো এত ভালোভাবে কেউ তৈরি করেনি। সে সব তো ঠিকই আছে; কিন্তু আপনার আবিষ্কার যাতে বেদখল হয়ে না যায় তারও তো চেষ্টা করতে হবে! হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন— পেটেন্ট। বিজ্ঞানী, উদ্ভাবকদের নিজেদের আবিষ্কারের ওপর যাতে চিরস্থায়ী ছাপ থাকে, কর্তৃত্ব বজায় থাকে সেটারই চেষ্টা আর কী। ভারত বলুন বা বিশ্ব— সেই কবে থেকে কত শত জিনিস পেটেন্টের আওতাভুক্ত হচ্ছে। সবই সৃষ্টির উল্লাস!
এতকিছু তো হল, পেটেন্টের ইতিহাস কী জানায় আমাদের? এই গল্প সেই ইতিহাস নিয়েই। ভারতের বুকে বিজ্ঞান প্রতিভার অভাব নেই। কালে কালে যুগান্তকারী সব গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এখানকার বিজ্ঞানীরা। তৈরি করেছেন আশ্চর্য সব জিনিস, যন্ত্র। এই ভারতেই পেটেন্টের ইতিহাস কবে থেকে শুরু হয়েছিল? এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গেলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে। দেখতে হবে এক সাহেবের কীর্তি, যার হাত ধরে ভারত দেখেছিল প্রথম পেটেন্টের উদাহরণ…
সালটা ১৮৫৬। আর একবছর পরেই ভারতের ইতিহাসে ঘটে যাবে সিপাহী বিদ্রোহ। সেসব এখন থাক। ১৮৫৬ সালে একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হয় দেশে। নাম ‘পেটেন্ট রাইটস অ্যাক্ট’। বিজ্ঞানী, উদ্ভাবকরা যা আবিষ্কার করছেন, যে যন্ত্র নিয়ে আসছেন নতুনভাবে, সেসবের ওপর যাতে তাঁর আইনি অধিকার থাকে সেটা সুনিশ্চিত করতেই এমন আইন। বলা ভালো, গবেষণার জগতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এটি। সেই বছরেই মার্চ মাসে নিজের তৈরি একটি যন্ত্র সামনে নিয়ে এলেন জর্জ অ্যালফ্রেড ডিপেনিং। কলকাতাতেই থাকতেন এই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ব্রিটিশ সরকারের সামনে তিনি নিয়ে এলেন তাঁর বিশেষ যন্ত্র ‘অ্যান এফিসিয়েন্ট পাঙ্খা পুলিং মেশিন’। অর্থাৎ, পাখা টানার মেশিন। পাঠকদের খেয়াল পড়বে হাতে টানা পাখার কথা। একটা সময় বাংলার বড়ো বড়ো বনেদি ও জমিদার বাড়িতে যার ব্যবহার প্রচলন ছিল। কিন্তু সেটা টানার জন্য কাউকে থাকতে হত। জর্জ অ্যালফ্রেড ডিপেনিং সেটাকেই যন্ত্রের রূপ দিলেন। তাহলে আর সারাটা সময় কাউকে কষ্ট করতে হবে না।
১৮৫৬-এর সেপ্টেম্বর মাসে ছবি ও কার্যপ্রণালী-সহ নিজের কাজ জমা দেন ডিপেনিং। ব্যস, এরপর তৈরি হল ইতিহাস! তাঁর তৈরি করা সেই ‘পাঙ্খা পুলিং মেশিন’ই ছিল ভারতের প্রথম পেটেন্ট অ্যাপ্লিকেশন। সেখান থেকে শুরু হল ইতিহাসের জয়যাত্রা, যা আজও চলে আসছে।
আরও পড়ুন
যাদবপুরে তৈরি মাস্কের পেটেন্ট নিয়ে গেল আমেরিকা, ক্ষুব্ধ উপাচার্য
কাহিনি এখানেই থেমে যেতে পারত। কিন্তু থামেনি; বলা ভালো থামতে দেননি ডিপেনিং সাহেব। তিনি দেখলেন, ভারতের বহু বিজ্ঞানী ক্রমাগত পেটেন্ট পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছেন ক্রমশ। এই অবস্থা দেখতে পারলেন না জর্জ অ্যালফ্রেড ডিপেনিং।তৈরি করলেন নিজের একটি সংস্থা ‘ডিপেনিং অ্যান্ড ডিপেনিং’। পেটেন্ট এজেন্ট হয়ে তাঁরা পাশে দাঁড়াতে শুরু করলেন সেই বিজ্ঞানীদের, যাঁরা চাইছেন নিজের কাজের স্বীকৃতি। সেটাও শুরু হয় ১৮৫৬ সালে। তখন থেকে শুরু করে আজও বিজ্ঞানীদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটি। শুধু নিজে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই থেমে থাকেননি; অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও যাতে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন সেটাও নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিশ্বে মাইক্রোবায়োলজির প্রথম পেটেন্ট তাঁর নামে, নীরবেই চলে গেলেন বাঙালি গবেষক আনন্দমোহন