এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয় আরতির

একদিকে ইংল্যান্ড, অন্যদিকে ফ্রান্স— মাঝখানে দিগন্ত বিস্তৃত আতলান্তিক মহাসাগর। সামনে অকুতোভয়ী এক বাঙালি নারী। অনেক সংগ্রামের পর এসেছেন এই জায়গায়। স্বপ্নপূরণের মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু একটি সমুদ্র। তিনি পারলেন। সমুদ্রের অন্য পারে পুঁতে দেন ভারতের পতাকা। ভারতীয় তো বটেই, প্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করেন আরতি সাহা। 

সালটা ১৯৪৪। বছর চারেকের আরতিকে নিয়ে চাঁপাতলা ঘাটে আসেন তাঁর কাকা। সেখানেই জলের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হয় তাঁর। স্নান করতে নেমে একটু একটু করে সাঁতার শেখা, পরে সেটাই নেশায় পরিণত হয়। সাঁতার যে আরতির সহজাত প্রতিভা, সেটা বুঝে ফেলতে বেশি সময় নেননি তাঁর বাবা, পাঁচুগোপাল সাহা। শেষমেশ সেই সময়ের অন্যতম সেরা সাঁতারু শচীন নাগের কাছে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। হিরে চিনতে ভুল করেননি অভিজ্ঞ শচীনও। এক বছরের মধ্যেই নিজেকে প্রমাণ করলেন আরতি সাহা। একটি সাঁতার প্রতিযোগিতায় মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ফ্রি-স্টাইল সুইমিংয়ে সোনা জেতেন তিনি। 

ব্যস, এখান থেকেই যাত্রা শুরু এক কিংবদন্তির। পথটা খুব সহজ ছিল না। ভারত এর আগে সেভাবে কোনো মহিলা সাঁতারু পায়নি। সেখানে ছোট্ট বয়স থেকেই একের পর এক প্রতিযোগিতায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে থাকেন আরতি। সহজাত প্রতিভা তো ছিলই; সেইসঙ্গে ছিল কঠোর পরিশ্রম। রাজ্য থেকে জাতীয় স্তর— ১৯৪৬ সাল থেকে টানা দশ বছর তিনি সব জায়গায় সাফল্য পান। ১৯৪৮ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো ও ব্রোঞ্জ জয়; তার এক বছর পর সাঁতারে অল ইন্ডিয়া রেকর্ডও তৈরি করেন। সেই সময় আরেক মহিলা সাঁতারু ডলি নাজিরের ব্যক্তিগত রেকর্ডও ভাঙেন তিনি। 

১৯৫২ সাল। প্রত্যেক ক্রীড়াবিদের স্বপ্ন থাকে বিশ্বের মঞ্চে নিজের দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার। আর সেটা যদি অলিম্পিকের মঞ্চ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আরতি সাহার প্রতিভা অচিরেই ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে আলোড়ন তৈরি করে। সাঁতারে আরও এক প্রতিভার জন্ম হয়েছে। কাজেই তাঁকে মঞ্চ দেওয়া জরুরি। ১৯৫২-এর হেলসিঙ্কি অলিম্পিক টিমে জায়গা পেয়ে যান আরতি সাহা। এই বছরটি তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়তেই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। সামনে দেখেন আরও এক সাধারণ বাঙালি সাঁতারু অসম্ভব পরিশ্রম ও দক্ষতায় পেরিয়ে যাচ্ছেন ইংলিশ চ্যানেল। তৈরি হয় ব্রজেন দাস নামক এক মিথ। তাঁকে দেখে আরতিও সিদ্ধান্ত নেন, দূরপাল্লার সাঁতারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবেন। নিজের সেরা ব্রেস্টস্ট্রোক-কে আরও পরিণত, আরও তীক্ষ্ণ করবেন তিনি। 

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় সাঁতারু হিসাবে সরাসরি অলিম্পিকে সজন প্রকাশ

রূপকথা বোধহয় এরকম জেদ থেকেই তৈরি হয়। হয়ত অনেকের কাছে এসব পাগলামো, কিন্তু এই পাগলরাই তৈরি করেন পৃথিবীর ইতিহাস। সাঁতারু জীবনে দুজন মানুষকে সম্মান করে এসেছেন বরাবর— মিহির সেন এবং ব্রজেন দাস। দুজনের কাছেই ছুটে গিয়েছিলেন পরামর্শ নেওয়ার জন্য, শেখার জন্য। আরতি’র চোখে তখন একটাই স্বপ্ন, ইংলিশ চ্যানেল। এর আগে এশিয়ার কোনো মহিলা সাঁতারু এই দুরূহ অভিযান সম্পন্ন করতে পারেননি। সেটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন আরতি সাহা। দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে শুরু হল কঠোর অনুশীলন। নিজের শরীরকে প্রস্তুত করতে হবে। তার জন্য যা করার দরকার, তিনি করবেন। 

আরও পড়ুন
বিশ্বের প্রথম সাঁতারু হিসেবে পানামা খাল জয়ের রেকর্ড এক বাঙালির!

শরীর তো প্রস্তুত হল; কিন্তু অর্থ? ইংলিশ চ্যানেল অভিযানের স্পনসর কে হবে? তিনি যাবেন কী করে? তখন আরেক চিন্তা এসে হাজির হল। কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি আরতিকে। স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। আর কোনো ভয় নেই। ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন আরতি সাহা। প্রথমবার চেষ্টা করেন; কিন্তু বেশ কিছু কারণে সফল হননি। তবে হার মানেনি। সেপ্টেম্বর মাসে আবার এসে গেল সুযোগ। ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ম্যারাথন জার্নি, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জলে নেমে পড়লেন আরতি সাহা। বাকিটা ইতিহাস! তখনও কুড়ি পেরোননি আরতি সাহা। এত কম বয়সে ইংলিশ চ্যানেল পেরোনোর নজির খুব একটা দেখা যায় না। তার ওপর এশিয়ার প্রথম মহিলা যিনি ইংলিশ চ্যানেল জয় করলেন! 

ভারতের সাঁতারের ইতিহাসে সেটা ছিল বিরাট এক দিন। এমন নজির এর আগে কেউ করেননি। তার প্রতিদানও মিলল সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯৬০ সালে দেশের প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পদ্মশ্রী সম্মান পান আরতি সাহা। নিজেই হয়ে ওঠেন জীবন্ত কিংবদন্তি। শুধুমাত্র তাঁকে দেখেই আরও কত মেয়ে সাঁতারের রাস্তা বেছে নিয়েছে। হাজার হাজার কোনিদের মুখে শোনা গেছে লড়াইয়ের গল্প। ‘ফাইট, কোনি, ফাইট’ মন্ত্রটি থাকতই না; যদি আরতি সাহা না থাকতেন। আক্ষেপ, ১৯৯৪ সালে খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি সাঁতারু। 

কিন্তু ভারত তথা পৃথিবীর ক্রীড়া ইতিহাস কি তাঁকে ভুলতে পারবে? ২০২০ সালে গুগল-ডুডল স্মরণ করেছিল তাঁকে। নীল সমুদ্রের মাঝে লাইন দিয়ে চিহ্নিত একটি বিশেষ পথ। আর গুগলের সঙ্গেই সেখানে উঠে আসছে একজন নারীর কার্টুন। ডুডলের সৌজন্যেই বিস্মৃতির সমুদ্র থেকে পুনরায় উঠে এসেছেন কিংবদন্তি সাঁতারু আরতি সাহা।

তথ্যসূত্র-
১) ‘Arati Saha: who was groundbreaking Indian swimmer and why is Google honouring her?’, Tom Barnes, Independent UK
২) ‘রেকর্ড গড়া বাঙালি সাঁতারুকে শ্রদ্ধা, জন্মদিনে গুগল ডুডল আরতি সাহা’, সংবাদ প্রতিদিন

Powered by Froala Editor