‘কেহ বা ধরিল হাত কেহ বা চরণ।/ উঠ উঠ এস এস বলে পাঁচজন॥/ হানা-হানি টানা-টানি হেঁচড়ানি কত।/ ভোটদাতা বলে হায় হইলাম হত॥ বাপু বাপু মরি মরি গেলাম গেলাম।/ ছেঁড়ে দাও কেঁদে বাঁচি পেয়েছি ইনাম॥’
ঔপনিবেশিক কলকাতার লোকজন ভোট ব্যাপারটা শুনেছিলেন বটে, কিন্তু কোনোদিন তাতে অংশ নিতে পারতেন না। বিলাতি সাহেবদের ক্রিকেট খেলার মত এও এক খেলা বলে ভাবতেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে গণতন্ত্র আর ভোটদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োগের ধারণা দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারলেন। এদিকে মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নেবার পরে দেশ চালনার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মকানুনও বলবৎ হল। তাঁদেরই একটা ছিল নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোটগ্রহণ। এই ভোট প্রথমে একমাত্র শাসক ইংরেজরাই দিতে পারতেন। কিন্তু নেটিভদের ক্রমাগত চাপে ১৮৭৪ সালে ইংরেজ সরকার পৌর আইন সংশোধন করে প্রথমবারের মতো ‘নেটিভ’ নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়। শুরু হয় নবগঠিত কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নির্বাচনের তোড়জোড়। আর সেই প্রথম বাঙালি প্রথমবারের মত ভোটরঙ্গে অংশীদার হবার সুযোগ পেল।
প্রথমবারের সেই ভোট নিয়ে খবরের কাগজের শুকনো বিবরণ ছাড়া অন্য কিছু হয়তো জানাই যেত না, যদি না সেই বছরই বাংলায় দুটি আশ্চর্য পত্রিকা প্রকাশ পেত। একটির নাম ‘হরবোলা ভাঁড়’ ও অন্যটি ‘বসন্তক’। বিলাতী পাঞ্চ পত্রিকার অনুকরণে গড়ে ওঠা এই দুই পত্রিকার মূল রস ছিল ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ আর শ্লেষ। এককালে হুতোম যে নকশাধর্মী ফিচার লিখে গেছিলেন, একেবারে অবিকল তেমনই ঘরানায় পত্রিকাদুটি তাঁদের রচনা প্রকাশ করত। শুরুতেই ‘এই অ্যাক নূতন’ বিষয় হিসেবে ভোটের অলীকরঙ্গে মেতে ওঠে তাঁরা। ফলে একেবারে প্রথম ভোটেও ঠিক কী রকম পরিবেশ ছিল, তা ছবির মত পরিষ্কার।
১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে বসন্তকে প্রকাশিত ‘ইলেকশন’ নামে এক রচনায় দেখি বেশিরভাগ মানুষের কোন ধারণাই নেই এই ভোট ব্যাপারটা ঠিক কী। তাঁরা জনে জনে “ভোট, ভোট কী মহাশয়?” জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়াচ্ছে। মজা হয় ঠিক এর পরে। ভোট দেবেন কি না এই প্রশ্নে এক এক জন তাঁদের মত দেন। আর সেই মতের সঙ্গে আজকের জনমানসের মতের খুব বেশি তফাৎ নেই। “তিনি শুনিয়া কহিলেন, ‘আমি বিবেচনা করিব, এর পর যাহা হয় দেখা যাবে।’ ...অন্য আর একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি উত্তর করিলেন ‘আমি ভোট দিব না, একজনও উপযুক্ত ব্যক্তি নহেন।’ ...অন্য লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম... কেহ বলিলেন, ওহে ঠাকুর! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে কেন? ঘরে গিয়ে হরিনাম করগে, পরকালের কায হবে।” মানে একেবারে প্রথম ভোট থেকেই নোটার একটা লুকানো চাহিদা ছিলই।
আরও পড়ুন
দীর্ঘ লড়াই-এর পর স্বীকৃতি, এবার ভোট দেবেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরাও
এ তো গেল ভোটারদের কথা। কিন্তু ভোটের জন্য প্রার্থীদের দুয়ারে দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বান ডাকানো, এসবেরও শুরু কিন্তু সেই প্রথম ভোট থেকে। বসন্তকের ১২ সংখ্যায় অদ্ভুত এক কার্টুন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনামে লেখা ছিল ‘আমাদের গৌরে মুদি সবে বাটীটির দ্বারটি খুলিয়া কী দেখিলেন।’ ছবিতে খাটো ধুতি, খালি গায়ে টিকিওয়ালা গৌরে মুদি দেখছেন, তাঁর বাড়ির দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন মান্যগণ্য ভোটপ্রার্থীরা। প্রত্যেকের হাতে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অ্যাজেন্ডা। আর ভোটের দিন! সেদিন তো মহা রঙ্গ। ‘বৈকালে সংবাদ পাইলাম, যে মহা হুলস্থুল লাগিয়াছে, যাঁহারা এত দিন অভিমান করিয়া আসরে নাবেন নাই, তাঁহারা সকলে নাবিয়া কিসে ভোট পাওয়া যায়, ইহারই চেষ্টা করিতেছেন। ...কোনো স্থলে হুড়াহুড়ি, কোনো স্থলে মারামারি অবধি হইতেছে। কি সর্ব্বনাশ! সকলে কমিসনর হইতে চেষ্টা পাইতেছেন।...’
আরও পড়ুন
এশিয়ার একমাত্র ভোটের কালি তৈরির কারখানা ভারতেই!
এই কমিশনার হবার লোভ বড় বালাই। তখন আর সযত্নে লালিত জাতপাতের বালাই থাকে না। উচ্চ বর্ণের বাবুও বুঝে যান তিলি বা জেলের ভোটটাও বামুনের ভোটের মতই জরুরি। বেশ কিছুদিন পরে ১৮৯২ সালের পুরসভা ভোটের আগে ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায় এক কৌতুক নকশা ছাপা হয়। তাতে তৈলিক ভবনে গিয়েছেন ভোটপ্রার্থী। তিনি মান্যগণ্য লোক। ভিক্ষা চাইছেন তিলির কাছে— ‘পাত্র মিত্র সঙ্গে করে যায় বাবু কলু-ঘরে/ গিয়ে পড়ে কলুর চরণে,/ দোহাই তোমার লাগে ভোট দাও আগে ভাগে/ কহি শুন কাতর বচনে”। তবে বাবু জানেন শুধু চোখের জলে মন ভেজানো মুশকিল। তাই জেলের বাড়ি গিয়ে তিনি সরাসরি লোভ দেখালেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন ভোট দিলে তিনি তাঁর কাছ থেকেই নগদ টাকায় কুড়ি মণ মাছ কিনে নেবেন: ‘ভোট দিয়া কিনে লও, জনম মতন।/পিতৃ-শ্রাদ্ধে বিশ মণ, মাছের বায়না।/লও মূল্য, গণি এবে, টাকা-পাই-আনা।’
পত্রিকায় ছড়ার সঙ্গে ছবিও ছাপা ছিল। ছবির পরিচয়ে লেখা আছে ‘পোলিং চক্র’। ছবিটি মারাত্মক। তাতে ভোটারকে চেয়ারে বসিয়ে দুইজন তাঁর হাত টেনে ধরেছেন আর দুইজন পা। চশমা চোখে, দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি প্রায় জোর করেই তাঁকে মদ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে তাঁর ভোট পেতে উদ্যত। যাদের এই নেশাতেও কাজ দিত না তাঁদের জন্য থাকত দিব্যির ভয়। কী রকম? শুনুন তবে “সবার ভোট কাড়িয়ে লইয়া আমাকে দিবে। কারণ আমি সর্বদলভূক্ত সবলোট (সাব লাটসাহেব)। ইহার কোন ব্যাতিক্রম করিবেন না, করিবেন না, করিবেন না, মাতার দিব্য! জগন্নাথক্ষেত্রের সুভদ্রার দিব্য! কালীঘাটের হালদারদের দিব্য! আর বাগবাজারের মদনমোহন খোলার ঘরের দিব্য!”
আরও পড়ুন
চিনেভাষায় 'খেলা হবে', ভোটের দেওয়াল জুড়ে 'চিনে কলকাতা'
প্রথম পুরভোটের উত্তাপ ছড়িয়েছিল বটতলা সাহিত্যেও। ভোটমঙ্গল বা দেবাসুরের মিউনিসিপাল-বিভ্রাট নামের বটতলার বইতে অজ্ঞাতনামা লেখক পুরাণের ছলে সেদিনের বাঙালির ভোটের স্বরূপ একেবারে ছবির মতো তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। ভোট কেনাবেচা একেবারে শুরু দিন থেকেই চালু ছিল। শুধু চালুই ছিল না, প্রায় সব প্রার্থীই নানা প্রলোভনে ভোটারকে ভোলাতে চাইতেন। একটু উদ্ধৃত করি ‘সেদিন আমার কত্তাকে নিয়ে হুলস্থূল বেঁধে গেছল। ইন্দিরবাবু বলেন, “দুটো ভোট আমারে দিও,” হুতুমবাবু বলেন, “তা হবে না, আমাকেই দুটো দিতে হবে।” শেষে দাঙ্গার উয্যুগ আর কি! তার পর হুতুমবাবু রাত্রে কত্তাকে ডাকিয়ে নিয়ে এক থান বনাত, ২৫টে টাকা নগদ... আর এক জোড়া সিমলের জুতো দিয়ে ভোট দেবার জন্যে কত্তাকে কবুল করে নেচেন।’
যম দত্ত তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন তখন নাকি আজকের মত গোপন ভোট হত না, খোলাখুলি ভোট হত। “সেবার ডাক্তার নীলমাধব চট্টোপাধ্যায়ের সহিত জীবন কৃষ্ণ সরকারের জ্যাঠার ভীষণ ভোটাভুটি”। ডেপুটিবাবু ভোট নিচ্ছিলেন। তিনি ভোটারদের জিজ্ঞেস করলেন কাকে ভোট দেবে? কেউ বলল ক্যাশবাবুকে। কে ক্যাশবাবু? না যিনি সরকারি ক্যাশ বিভাগে কাজ করেন, সরকার মশাইয়ের নামে ভোটের দাগ পড়ল। কেউ আবার ডাক্তারবাবুকে ভোট দিলেন। শেষের দিকে ডাক্তারবাবুর দশটা ভোট বেশি হচ্ছে। এরপর সরকার মশাই যা করলেন, আজকের দিনে সেটাকেই ঘোড়া কেনাবেচা বলে। ক্যাসবাবু হবার সুবাদে তিনি একটাকা দিয়ে ভোটার কিনতে শুরু করলেন। বিপদ দেখে ডাক্তারবাবুও রেট বাড়িয়ে দুই টাকা করলেন। এইভাবে ভোটের শেষের দিকে প্রতি ভোটারের রেট পাঁচ টাকা অবধি উঠল। ভোটঅন্তে দেখা গেল তিন ভোটে সরকার মশাই জিতেছেন।
ভোট পাবার জন্য প্রার্থীরা প্রাণ দিতেও রাজি। একবার এক গোঁসাইজি ভোটে দাড়িয়েছেন। কমিশনার হিসেবে তাঁর বদনাম ছিল। সরকারি টাকায় ড্রেনেরে ধারের জঙ্গল সাফ না করে তিনি নিজের বাড়ি সাফ করাতেন। লোকে রেগে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ম্যাকিনলেকে দাঁড় করিয়ে দিল। গোঁসাইজি দেখলেন এবার জেতা বড় মুশকিল। শেষে হিসেব করে ঠিক করলেন মুচি পাড়ার ষোলটা ভোট যদি পান, তবে তাঁকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। এক দুপুরে চুপিচুপি তিনি সে পাড়ার মাতব্বর সদানন্দ মুচির বাড়ি গেলেন। বাড়িতে তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের সুন্দরী স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিল না। গোঁসাইজি তাঁকেই অনুরোধ করতে লাগলেন। এর মধ্যে সদানন্দ এসে ভাবলে তাঁর অনুপস্থিতিতে গোঁসাই নিশ্চয়ই কুমতলবে তাঁর বাড়ি এসেছে। সে পেরেক ঠোকা নেহাই দিয়ে গোঁসাইকে এমন মারল যে গোঁসাইয়ের প্রাণ যায় যায়। সদার বৃদ্ধা মা ঘর থেকে সব শুনেছিলেন। তিনিই গোঁসাইকে রক্ষা করলেন। সদানন্দ ভুল বুঝে ক্ষমা চাইল। গোঁসাই বললেন ”যদি তোমার ষোলটা ভোট আমাকে দাও তবে ব্রহ্ম রক্তপাতের জন্য তোমার কোন পাপ লাগিবে না।” সেই ষোল ভোটের জোরে শুধু সেবারই না, আমরণ কাল অবধি গোঁসাইজিই কমিশনার ছিলেন। “মুচিপাড়ার ভোট তিনি বরাবর পাইতেন।” ভাবা যায়! সাধে কি দাদাঠাকুর বলেছিলেন “‘হে স্বায়ত্তশাসনের বাহন, হে ভোট, হে অঘটনঘটনপটীয়ান্, তোমার চরণে কোটি কোটি নমস্কার।”
Powered by Froala Editor