“নির্বাচিত সরকারই হোক কিংবা বিরোধী পক্ষ— সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই দেশপ্রেমিক এবং জ্ঞানী। সার্বিকভাবে তাঁরা যা পদক্ষেপ নেবেন, তা দেশের চূড়ান্ত মঙ্গলের জন্যই। তাঁদের ওপর ভরসা রাখুন…”
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৫৩ সাল। সুদানিজ রেডিও থেকে সম্প্রচারিত হয়েছিল এক দীর্ঘ বক্তৃতা। ভাঙা ভাঙা ইংরাজি উচ্চারণ। বক্তা যে ইংরেজ নন, তা বোঝা যায় হলফ করেই। আফ্রিকান টানের সাথেও এই উচ্চারণে বিস্তর ফারাক। তবে? সুদানিজ রেডিও-তে দেওয়া সেদিনের সেই দীর্ঘ বক্তৃতার পিছনে থাকা মানুষটি আসলে একজন ভারতীয়। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে এক বাঙালি।
সুকুমার সেন (Sukumar Sen)। না, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক সুকুমার সেনের কথা হচ্ছে না। আমাদের গল্পের নায়ক স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার এবং স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবাংলার প্রথম চিফ সেক্রেটারি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি অতিপরিচিত হলেও, সার্বিকভাবে এদেশের জনগণের স্মৃতি থেকে প্রায় মুছে গিয়েছেন এই কিংবদন্তি বাঙালি ব্যক্তিত্ব। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সুদানের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন তিনি? কেনই-বা তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন সুদানের রেডিও-তে সে-দেশের মানুষদের উদ্দেশ্যে?
গল্পটা শুরু করা যাক একটু আগে থেকে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় ভারত। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়ভার তুলে নেন জওহরলাল নেহরু। তবে দেশ শাসনে তৎকালীন যে-সরকার তৈরি হয়েছিল ভারতে, তা কোনো নির্বাচিত সরকার ছিল না। বরং, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বিশিষ্ট নেতৃত্বদের নিয়ে। কিন্তু এই সরকারই যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকে, তবে ভারত যে স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও, গণতন্ত্র হয়ে উঠবে না কোনোদিন। ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়নের পরই, তাই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন নেহরু।
কিন্তু কীভাবে হবে এই নির্বাচন? দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই যে নিরক্ষর। প্রার্থীর নাম পড়ার ক্ষমতাই যে নেই তাঁদের। দ্বিতীয়ত, এ-দেশের জনসংখ্যা এবং আয়তনও কম নয় মোটেই। তাঁদের এক ছাতার তলায় এনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো তো আর মুখের কথা নয়। এই চ্যালেঞ্জিং কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন আইসিএস সুকুমার সেন। সম্পর্কে কিংবদন্তি ব্যারিস্টার, বিচারপতি এবং প্রাক্তন সাংসদ অশোক কুমার সেনের ভাই তিনি। নিরক্ষর মানুষকে নির্বাচন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে তিনি হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন রেডিওকে। আঞ্চলিক ভাষায় শুরু হয়েছিল প্রচার। সেইসঙ্গে নামের বদলে বিশেষ বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে দল বা প্রার্থীর পরিচয়কে চিহ্নিত করেন তিনি। সেইসঙ্গে প্রস্তুত করেছিলেন সাড়ে ১৭ কোটি ভোটারের তালিকা।
১৯৫২ সালে তাঁর নেতৃত্বে যখন সফলভাবে পরিচালিত হয় ভারতের প্রথম নির্বাচন, তখন সুদূর আফ্রিকার স্বাধীনতার আদায়ের লড়াই চালাচ্ছে সুদান। ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করে, ছেড়ে যাবে উপনিবেশ। কিন্তু কারা গোটা দেশের শাসন ব্যবস্থা সামলাবে, তা নিয়েই বিতর্ক দেশের রাজনৈতিক মহলে। সেই সূত্রেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচনের প্রস্তাব দেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু সুদানে এহেন নির্বাচন আয়োজনের মতো পরিকাঠামো নেই, নেই কোনো বিশেষজ্ঞও। তবে উপায়? ডাক পড়ল সুকুমার সেনের। তুরস্ক থেকে ব্রিটেন— আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তখন চর্চার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তাই শ্বেতাঙ্গ শাসকদের পাশে সরিয়ে এই ‘ব্রাউন সাহেব’-কেই নির্বাচনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন সুদানিজরা।
না, ফেরাননি তিনি। সুদানিজ মানুষদের অনুরোধ রাখতে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদানে। সুদানের অবস্থাও ছিল অনেকটা এ-দেশের মতোই। সেখানে শিক্ষার হার কার্যত তলানিতে। পাশাপাশি নির্বাচন করানোর ক্ষেত্রে আরও বড়ো একটি প্রতিবন্ধকতা ছিল সে-দেশের প্রাকৃতিক গঠন। সমস্যার সমাধান করতে সুদানকে দু-ভাগে ভেঙে নিয়েছিলেন সুকুমার। উত্তরে নীল নদ এবং তার শাখানদী সংলগ্ন অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে নির্বাচন করিয়েছিলেন পৃথকভাবে। আবার দক্ষিণের অরণ্য ঘেরা অঞ্চলে বন্দোবস্ত করেছিলেন নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়। এ-দেশের পদ্ধতিতেই হয়েছিল সেই নির্বাচন। রং এবং বাহারি চিহ্নই প্রতীক ছিল প্রার্থীদের। অন্যদিকে ভোট সংগ্রহের জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ ব্যালট বাক্স। সেইসঙ্গে নির্বাচনের আগে ক্রমাগত প্রচার চালানো হয় রেডিও-তে।
তবে মজার বিষয় হল, সে-সময়ের সেনসাসের সঙ্গে ভোটার তালিকার সংখ্যা মিলিয়ে দেখলেই নজরে আসবে এক আশ্চর্য গরমিল। বয়সের নিরিখে ভোটাধিকার-প্রাপ্ত মানুষের সংখ্যার থেকে ভোটার তালিকার মোট সংখ্যার বিস্তর ফারাক। আসলে সুকুমার সেনের তৈরি ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন বহু মহিলা। বিশেষত যাঁরা তাঁদের স্বামী কিংবা পুত্রের পরিচয়ে ভোট দিতে চেয়েছিলেন, তাঁদেরকে মূল তালিকা থেকে সরিয়ে রাখেন তিনি। যুক্তি ছিল, তাঁদের এই পরিচয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে আজীবন বৈষম্যের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে সুদানের মহিলাদের।
উল্লেখ্য, সুকুমারের এই পরিকল্পনা যে সফল হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা থাকে না। ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনের পর সে-দেশের জাতীয় রেডিও থেকে গোটা দেশের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বার্তা দেন তিনি। জানিয়েছিলেন, সুদানে কাটানো ১৪টি মাস তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। পাশাপাশি সে-দেশের মানুষকে সতর্ক করেছিলেন, উন্নত দেশ হয়ে উঠতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে সুদানকে। আর তার জন্য নির্বাচিত সরকারের ওপরেই ভরসা রাখতে হবে তাঁদের।
মিশরের সংবাদপত্র ‘আল মিশরি’ সুদানের এই নির্বাচনকে আখ্যা দিয়েছিল ‘আ প্রোডাক্ট অফ দ্য জিনিয়াস অফ ইন্ডিয়া’। কুর্নিশ জানিয়েছিল পশ্চিমের একাধিক দেশ। তবে সুদানের এই সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বছর দুয়েকের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। একাধিকবার ক্ষমতার হস্তান্তর হয় বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের এই পরিস্থিতি সে-দেশে জারি আছে আজও। এমনকি ২০১১ সালে সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তৈরি করেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। আর সুকুমার সেন?
না, তাঁর এই বিস্তারিত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে একাধিক গবেষণা হলেও, ব্যক্তি সুকুমার সেনের কোনো তথ্যই লিপিবদ্ধ হয়নি কোথাও। নিজেও লেখেননি কোনো আত্মজীবনী। আজীবন প্রচারবিমুখ হয়েই হয়তো থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই হয়তো শেষ জীবনে ফের গণিত অধ্যয়নেই ডুব দিয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্বর্ণপদক-জয়ী সুকুমার। বাড়িতে রাজনৈতিক চর্চা থাকলেও, হাঁটেননি সে-পথে। আমরাই বা কতটা মনে রেখেছি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের অন্যতম কাণ্ডারিকে? বর্ধমানে তাঁর নামাঙ্কিত একটি সড়ক থাকলেও, তাঁর পরিচয় অজানা অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছেই। কথিত আছে সুদান সরকারও তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে নামকরণ করেছিল একটি রাস্তার। যদিও সে-দেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা মুছে দিয়েছে সেই ইতিহাস…
Powered by Froala Editor