বাঙালিদের ইতিহাসের সারণি দিয়ে হাঁটলে নানা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তার কতজনের খবর আমরা রাখি! কত মানুষ রয়ে যান ধুলোর ভেতর। যখন গা ঝাড়া দিয়ে সেই সব গল্প আমাদের সামনে আসে, প্রতিটা বাঁকে যেন রোমাঞ্চের পরশ লাগে। এবার যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, পুলিশ সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী? কেউ হয়ত এখনও ভয় পাবেন, কেউ হয়ত ওই উর্দিটাকে শ্রদ্ধা জানাবেন, কেউ হয়ত নানা অভিযোগ করবেন। আয়নার খণ্ড টুকরোর মতো তাঁরা আবির্ভূত হন সমাজে। তাঁদের ঘিরে যখন তৈরি হয় ইতিহাস আর মিথের একটা পরিমণ্ডল, তখন একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় না? অশোক কুমার মুখার্জির কথা শুনতে শুনতে সেই অতীতের ভেতরেই যে কখন ঢুকে পড়া…
বাংলা ও বাঙালির পুলিশের নানা কীর্তি ইতিহাসের পাতায় একপ্রকার চাপাই পড়ে আছে। বাঙালির ছেলে, পুলিশ হবে কী করে— এমন মনোভাব ব্রিটিশদের সময় থেকেই ছিল। স্বাধীনতার পরও এই মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে বদলায়নি। তবে মন্তব্য ভুল প্রমাণ করার মানুষও যুগে যুগে জন্মেছেন। সেইরকমই এক ‘কিংবদন্তি’ ছিলেন অশোক কুমার মুখার্জি। হ্যাঁ, কিংবদন্তিই বটে। অন্তত তাঁর জীবনই সেই কথা বলে দেয়। অনেকের মতোই অশোকবাবুর পরিবারও একটা সময় পূর্ববঙ্গে ছিলেন। দেশভাগ এবং তখনকার পরিস্থিতির জন্য সেখান থেকে চলে আসেন কলকাতায়। চল্লিশের দশকের ভারত এবং বাংলা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তার ওপর স্বাধীনতার লড়াই, দেশভাগ— টিকে থাকার যুদ্ধটা বড়ো কঠিন। আর বাঙালিদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার চল না থাকলেও ব্যারিস্টার হওয়ার প্রত্যাশা অনেক পরিবারেই ছিল। সেই সূত্র ধরে আইন নিয়েই স্নাতকস্তরের পড়াশোনা শুরু করেন অশোক কুমার মুখার্জি। পুলিশে কখনও আসবেন, এমন চিন্তা তখনও আসেনি তাঁর মাথায়…
আইন তো পাশ করলেন; এরপর? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর বিভাগে এবার যুক্ত হয়ে গেলেন অশোকবাবু। তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ানোর জন্য এসেছেন দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত। তাঁর কাছেই অর্থনীতির পাঠ নিতে শুরু করলেন অশোক মুখার্জি। ১৯৪৮ সালে স্নাতকোত্তরও পাশ করলেন। এবার?
এই ভবিষ্যতের প্রশ্নটা তখন বারবার সামনে এসে যাচ্ছিল। অশোকবাবু ছোটো থেকে দেখেছিলেন তাঁর বড়ো জ্যাঠামশাই, রায়বাহাদুর অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়কে। বলতে গেলে, তাঁর কাছেই মানুষ হওয়া। সারা বাংলা জুড়ে বহু স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি; নিজেও নেমে পড়েছিলেন শিক্ষকতায়। একান্নবর্তী পরিবার, অথচ আর্থিক অবস্থা সেরকম ছিল না। তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই বেড়ে উঠছিল এই পরিবারটিও। ভারতও তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। কর্মসংস্থান একটা বড়ো প্রশ্ন। এমন পরিস্থিতিতেই বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়ার জন্য কিছু তো একটা দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে চাকরির পরীক্ষায় বসা শুরু। সেনা বিভাগের সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসলেন। মেধাবী অশোকবাবু চাকরিও পেয়ে যান প্রথম সুযোগে। একজন শিক্ষানবিশ সামরিক অফিসার হিসেবে শুরু হল যাত্রা। পাড়ি দিলেন দেরাদুন…
আরও পড়ুন
কলকাতার প্রথম হ্যান্ড শ্যাডোর অনুষ্ঠান, গোটা বিশ্বকে টেক্কা দিয়েছিল দুই বাঙালিই
শুধু তো আর্থিকভাবেই নয়, বাড়ির বড়ো ছেলে মানে সে একজন অভিভাবকের মতো। পরিবারের বাকি মানুষগুলোরও দায়িত্ব নিতে হবে। শহর থেকে, ঘর থেকে অত দূরে থেকে কী করে সেসব করবেন অশোকবাবু? কেন্দ্রের অনেক পরীক্ষাও তখন বেরোচ্ছে, সেগুলোও দিতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু পারিবারিক প্রয়োজনটা যেন চেপে বসল। দেরাদুনের চাকরি ছেড়ে ফিরে এলেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু চাকরির চেষ্টা ছাড়েননি। পরের লক্ষ্য রাজ্য সরকারের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা। পরীক্ষাও দিলেন, পাশও করলেন। শুধু পাশই করলেন না; পুলিশের পরীক্ষায় গোটা রাজ্যে প্রথম হন তিনি। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হল তাঁর ইতিহাসের সরণি ধরা। এর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আরও একটা গল্প। চাকরি ছাড়া, কলকাতায় আসা এবং চাকরি খোঁজা— এই সময়ের মধ্যেও তো উপার্জনের জন্য কিছু করতে হবে! তা নাহলে সংসার চলবে কেমন করে? সেই সূত্রেই নৈহাটির ঋষি বঙ্কিম কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কাজ শুরু হয়। পুলিশ অফিসারের চাকরি পাওয়ার পর সেই অধ্যাপনার জীবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। নিয়তির ডাক কি শুনতে পেয়েছিলেন?
আরও পড়ুন
গড়গড়ার শব্দে চমকে দিয়েছিলেন সাহেবদের, বিস্মৃতির অতলে প্রথম বাঙালি বিলেতযাত্রী
১৯৫২ সালে চাকরিতে যুক্ত হবার পরই নানাভাবে নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন অশোক কুমার মুখার্জি। বলা ভালো, সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালের মে মাস; মাত্র চার বছর আগে চাকরিতে যুক্ত হয়েছিলেন অশোকবাবু। সেইসময়ই ঘটল একটি ঘটনা। খড়গপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কর্মীরা ধর্মঘট ডেকেছেন। ওইসময় কারখানাটিকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে আলোচনা চলছিল। তারই প্র তিবাদস্বরূপ ধর্মঘট ডেকেছিলেন কর্মীরা। একটা সময় পর সেই অবস্থানই হিংসাত্মক জায়গায় চলে যায়।
২৬ মে, ১৯৫৬। অরোরা হল্ট স্টেশনে এইরকমই প্রায় ৬০০ জন ধর্মঘটী পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঘিরে ধরেছিলেন স্টেশন চত্বর। দায়িত্বের কারণেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন অফিসার অশোক কুমার মুখার্জিও। হঠাৎই দেখলেন, একটি ট্রেন ঘিরে অরোরা স্টেশন চত্বর রণক্ষেত্রের চেহারা নিচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে কোনরকমে পালালেন ট্রেনের ড্রাইভার। কিন্তু বিপদে পড়লেন ফায়ারম্যান। ধর্মঘটীরা তাঁকে ট্রেন থেকে বের করে ট্র্যাকে ফেলে দিলেন। এদিকে ট্রেন চলছে, আর একটু এগোলেই কচুকাটা হয়ে যাবেন ফায়ারম্যানটি। কোনো কিছু না ভেবে ছুটলেন অশোকবাবু। নিজের জীবনের পরোয়া না করে ওই মানুষটাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁরই চেষ্টায় ফায়ারম্যানটি বেঁচে যান; কিন্তু গুরুতর আহত হন অশোকবাবু। অপর পক্ষের ছোঁড়া ইটের আঘাত লাগে মাথায়। খড়গপুরের হাসপাতালে প্রায় পাঁচদিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন তিনি। খুলি, কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আরও পড়ুন
আবিষ্কার করেছেন একের পর এক যন্ত্র, নিয়েছেন পেটেন্ট; বিস্মৃতির আড়ালে বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার
অনেকে ভেবেই নিয়েছিলেন, তিনি হয়ত বাঁচবেন না। হয়ত স্বাভাবিক কাজেও দেখা যাবে না। সেসব সামলে কয়েকদিনের মধ্যেই কাজে যোগদান করেন। আর তার তিন বছরের মধ্যে আসে বিরল সম্মান। তখন তিনি রানাঘাটে সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসারের দায়িত্বে। ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের সামরিক পদের অন্যতম বড়ো ও বিরল সম্মান ‘প্রেসিডেনশিয়াল পুলিশ মেডেল ফর গ্যালান্ট্রি’ পান অশোক কুমার মুখার্জি। বাঙালিদের মধ্যে এই সম্মান তখনও সেরকমভাবে কেউ পাননি। এমন বিরল সম্মান লাভ, তাও চাকরি জীবনের সাত বছরের মধ্যেই! গোটা দেশে হইচই পড়ে যায়। এ তো যাকে বলে একটা ইতিহাস তৈরি হওয়া! নিয়ম অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের গভর্নরের দেওয়ার কথা হলেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় অশোকবাবুর হাতে এই সম্মান তুলে দেন।
এই পুরস্কার তাঁকে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিচিত করে তোলে। এর মধ্যেই তাঁর জীবনে হাজির হয় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস (ইএফআর)। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের এই বিশেষ বাহিনীটির সম্পর্কে খানিক কথা না বললেই নয়। সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে এই বাহিনীর পথ চলা। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই যুক্ত থেকেছেন এখানকার আধাসামরিক জওয়ানরা। দেশভাগের আগে ইএফআরের মূল জায়গা ছিল ঢাকায়। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে এটি। এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, ইএফআর ভারতীয় সেনার অধীনে নয়; বরং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অধীনে থাকা ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ আধাসামরিক বাহিনী এটি। যা প্রায় অকল্পনীয় ও গর্বের একটি ব্যাপার। এবং এদের বেশিরভাগই এসেছে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। ফলে সেখানকার সংস্কৃতিরও একটা ছেঁড়া সুতো এদের সঙ্গে জুড়ে পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন
ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ, বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের কপালে জুটেছিল ‘পাকিস্তানের চর’ তকমা
ব্রিটিশ শাসনের সময় এই বাহিনির কম্যান্ডান্ট বা কম্যান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে থাকতেন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর কোনো অফিসার। বাঙালি তো দূরের কথা, ভারতীয়দের কখনই এই পদে রাখা হয়নি। স্বাধীন হবার পর ইএফআর যখন রাতারাতি ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে চলে এল, তখন ১৯৪৯ সালে মেজর মহব্বত সিং থাপা নামের একজন গোর্খা সেনা অফিসারের হাতে বাহিনীর দায়িত্ব পড়ল। একটু একটু করে আবার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে শুরু করল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস। একটা সময় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ‘এলিট ফোর্স’ বলা হত এই বাহিনীকে। যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে থাকার দরুন মেজর থাপার সঙ্গে এই ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত হলেন অশোক কুমার মুখার্জি। সেই সময় উত্তর-পূর্ব বেশ উত্তাল ছিল। মণিপুর, নাগাল্যান্ড-সহ নানা জায়গায় সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ই ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের বাহিনি সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চলে যায়। আর তাঁদের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন অশোক মুখার্জি। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে সেখানে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। শুধু তাই নয়, সেনা জওয়ানদের সঙ্গে যাতে ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়, সেজন্য নিজেই উদ্যোগ নিয়ে নেপালি ভাষা শিখলেন। একজন পুলিশ অফিসারের নিজের কাজের প্রতি কতটা ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকলে এই কাজটা করতে পারেন?
তবে তাঁর দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত নমুনা দেখা যায় ষাটের দশকে। বাংলার সেই উত্তপ্ত ষাটের দশক— একে খাদ্য আন্দোলন, পুলিশের অন্দরে বিদ্রোহ তো ঘটছিলই; পরে শুরু হল নকশাল আন্দোলন। বাংলার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ল সেই আগুন। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা। স্রেফ পুলিশ দিয়ে এই আগুন নেভানো তখন দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছিল। অতএব, সেনা নামাতেই হবে। আর এখানেই আবারও উঠে এল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস। এবারে দেখা গেল সমস্যা। ছোট্ট একটা বাহিনী, একটাই ব্যাটেলিয়ন; কত তার সামর্থ্য? শেষমেশ ঠিক করা হল, ইএফআরের নতুন একটা ব্যাটেলিয়ন তৈরি করা হবে। এখান থেকেই তৈরি হল সেকেন্ড ব্যাটেলিয়ন অফ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস। এবার এর কম্যান্ডান্ট বা কম্যান্ডিং অফিসার কে হবেন? মেজর মহব্বত সিং থাপা তো প্রথম ব্যাটেলিয়নের দায়িত্বে। আগে অবশ্য গুডল নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অফিসার কয়েকদিনের জন্য সেকেন্ড ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তারপর নজর গেল অশোক কুমার মুখার্জির দিকে। মেজর থাপার পরেই তিনি, আর তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে বাতুলতা। শেষমেশ তৈরি হল আরও একটা ইতিহাস। এই প্রথম কোনো বাঙালি এবং পুলিশ ইএফআরের ইতিহাসে কম্যান্ডান্ট হলেন। যা পুলিশ ও বাঙালির ইতিহাসে এক মহান কৃতিত্ব…
সেকেন্ড ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁদের ঠিকানা হল মেদিনীপুরে। সেখানে কেশিয়ারির ঘন জঙ্গলের ভেতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তৈরি করা পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি ছিল। সেখানে জওয়ানদের নিয়ে চলে গেলেন অশোক মুখার্জি। তাঁর অধীনে যারা আছেন, সবাই এসেছেন উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। এই জঙ্গলের ভেতর তাঁদের মনোবল অটুট রাখার দায়িত্বও তো একজন অফিসারের হওয়া উচিত। ঠিক সেই কাজটাই করলেন অশোকবাবু। বলা ভালো, প্রায় একা হাতে একটা ঐতিহ্যশালী ব্যাটেলিয়নকে সাজিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালের ওই উত্তুঙ্গ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নিজের জওয়ানদের জন্য তৈরি করলেন পাকা রাস্তা, বাজার, পার্ক, অফিস, কোয়ার্টার, ক্যান্টিন। এমনকি, যাতে মনোরঞ্জনও হয় সেজন্য তৈরি করলেন আস্ত সিনেমা হলও। সেই সিনেমা হলের হাত ধরেই প্রথম নেপালি সিনেমা ঢোকে (মাইতি ঘর)। একদিন ঘুরতে ঘুরতে দেখলেন তাঁর জওয়ানরা কী একটা জিনিস খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করাতে উত্তর এল- ‘কোকাকোলা’। ব্যস, সেনা চত্বরের ভেতরেই ঠান্ডা পানীয় তৈরির ব্যবস্থা করলেন। রীতিমতো প্যাকেজিং করে সব নিয়ম মেনে তৈরি হত এই পানীয়, যার নাম ‘মিনি কোলা’। জলের কষ্ট যাতে না হয়, সেজন্য পুকুরও খনন করান। আর সেই কাজে নিজে তো নেমেছিলেনই; সঙ্গে নিজের ছেলেকেও কোদাল হাতে নামিয়ে দিয়েছিলেন।
শুধুমাত্র সেনাদের মনোবল বজায় রাখার জন্য, একটা বাহিনীকে ঠিকঠাক রাখার জন্য একজন কম্যান্ডিং অফিসার যে এতটাও করতে পারেন, সেটা বোধহয় প্রথমে ভাবতেই পারেননি জওয়ানরা। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এমন দৃশ্য তো খুব একটা দেখারও সুযোগ হয় না। আর এই সবটাই করেছেন ষাটের দশকের শেষের দিকে। একইসঙ্গে খাদ্য আন্দোলন সামলেছেন, ভাটুপাড়ায় পাকিস্তান সেনাদের অনুপ্রবেশ সামলেছেন, পুলিশ আন্দোলন সামলেছেন। এই কাজগুলোই অশোক কুমার মুখার্জিকে কিংবদন্তির আসনে বসিয়ে দিল। আজও ইএফআরের সেকেন্ড ব্যাটেলিয়নে গিয়ে ওঁর নাম করলে লোকের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তিন বছরে পুরো ছবিটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। আর তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৩ সালে দুর্গাপুরে দক্ষিণবঙ্গের ডিআইজি সশস্ত্র পুলিশ পদে বসেন অশোক কুমার মুখার্জি। তাঁর হাত ধরেই এই শাখাটির সূত্রপাত।
ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেনাদের উন্নতির জন্য সমস্ত কিছু করেছেন। সেই ঐতিহ্যকে যেমন সম্মান জানিয়েছিলেন, তেমনই সেখানকার সেনারাও বুক ভরে ভালোবেসেছেন তাঁকে। যখন মুর্শিদাবাদে পোস্টিংয়ের জন্য মেদিনীপুরের সেনা ক্যাম্পাস ছাড়ছেন, তখন তাঁর সমস্ত সহকর্মী কেঁদেছিলেন। সেই মানুষটাই ২০১০ সালে যখন দেখলেন শিলদায় মাওবাদী হামলায় ইএফআরের ২৪ জন রাইফেলম্যান শহিদ হলেন, সেনা নিবাসে আগুন জ্বলল, এবং স্পেশ্যাল ইন্সপেক্টর জেনারেল বিনয় চক্রবর্তী ক্যামেরার সামনে এসে ইএফআরের দুর্দশার কথা বললেন, তখন আর সামলাতে পারেননি। শরীর খারাপ যাচ্ছিল অনেকদিন ধরেই, তাও কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নিজের হাতে তৈরি করা ইএফআরের এই পরিণতি তাঁকে আঘাত দিল। তিন-চারদিনের মধ্যেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ২০১০-এর অক্টোবরেই সবাইকে ছেড়ে চলে যান। তখনও কেঁদে যাচ্ছিলেন ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের সেকেন্ড ব্যাটেলিয়নের পুলিশ, সেনারা।
এইভাবেই বোধহয় ইতিহাস তৈরি হয়। রাজ্য ও জাতীয় পুলিশে একের পর এক বিরল সম্মান পেয়েছিলেন জীবনে; অধ্যাপনার নিশ্চিত জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন এমন পরিবেশে। শেষদিন পর্যন্ত ওই মানুষগুলোকেই ভালোবেসেছিলেন। তাঁরা মনে রেখেছেন এখনও; কিন্তু আমরা? বাঙালির ইতিহাস অশোক কুমার মুখার্জিকে হয়ত মনে রেখেছে। কিন্তু আমরাই কি ধুলো চাপা দিইনি সেগুলো? কেশিয়ারির ওই ঘন জঙ্গলের দিনগুলোরই হয়ত স্বপ্ন দেখতেন অশোকবাবু। হয়ত ছুঁয়ে দেখতেন খাকি উর্দিটা। বাঙালি কি পারবে না স্বপ্ন জয় করতে? ঠিক পারবে। অশোক কুমার মুখার্জির আদর্শই সেই আলোর পথযাত্রী…
কৃতজ্ঞতা ও তথ্যসূত্র— অরুণাভ নারায়ণ মুখার্জি, বিশিষ্ট অধ্যাপক এবং অশোক কুমার মুখার্জির কনিষ্ঠ পুত্র
Powered by Froala Editor