যেন জানলার পর্দার সরিয়ে বর্হিবিশ্বকে দেখতে চাইছেন এক তরুণী। মার্কিন ডলারের আদলে তৈরি সেই পর্দার ওপার থেকে তাঁর সঙ্গে উঁকি দিচ্ছে বিধ্বস্ত একটি শহরের ধ্বংসাবশেষ। বেরিয়ে আসছে উড়ন্ত যাত্রীবাহী বিমান। মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আগফানিস্তানের এই দেওয়ালচিত্র। নেপথ্যে, আফগানিস্তানের প্রথম মহিলা গ্রাফিটি শিল্পী শামসিয়া হাসানি। তালিবান কাবুলের দখল নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক দেওয়ালচিত্রের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ভয়াবহতাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি। আর সেই কারণেই কি চরমতম পরিণতির শিকার হতে হল তাঁকে? সেই সম্ভাবনাই ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশ।
কাবুল পতনের পর থেকেই তালিবান শাসকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদে নামতে দেখা গিয়েছিল আফগান মহিলাদের। সেই আন্দোলনের অন্যতম শরিক ছিলেন শামসিয়া। তবে তাঁর অবদান শুধু সীমাবদ্ধ ছিল না গণ-অবস্থানেই। বরং, শামসিয়া হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব জঁরকেই। তালিবান শাসিত কাবুলের বুকেই আত্মগোপন করে ফুটিয়ে তুলছিলেন একের পর এক গ্রাফিটি। নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে সেসব ছবি এবং কার্যকলাপের আপডেটও দিতেন তিনি। কিন্তু বিগত ৩১ তারিখের পরই আর কোনো হদিশ নেই তাঁর। কোনোরকম যোগাযোগও সম্ভব হয়নি বলেই জানাচ্ছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরাও। অনেকেরই আশঙ্কা, ‘বিদ্রোহী’ কার্যকলাপের জন্য তালিবানদের হাতেই প্রাণ গিয়েছে তাঁর।
আফগানিস্তানের কান্দাহারে জন্ম হলেও, শামসিয়া’র বেড়ে ওঠা ইরানে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে প্রাণ বাঁচাতেই সন্তানকে নিয়ে ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। তবে ছোটো থেকে শিল্পকলার প্রতি ঝোঁক থাকলেও, প্রথাগত শিক্ষা পাওয়ার কোনোরকম সুযোগ হয়নি তাঁর। ইরানে যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল আফগান মহিলাদের শিল্পচর্চা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ছবি দেখে নিজেই তুলি ধরা আয়ত্ত করেছিলেন শামসিয়া।
আরও পড়ুন
আফগানিস্তান থেকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলেন ভারতীয় রাজা
২০০৪ সালে আফগানিস্তানে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তাঁর পরিবার আবার ফেরে কাবুলে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অঙ্কন নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেন তিনি। পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার কাজও করতেন তিনি। তালিবানের কাবুল অধিগ্রহণের আগের দিন পর্যন্তও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করিয়েছিলেন শামসিয়া।
আরও পড়ুন
যৌনকর্মীদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, ‘হিটলিস্ট’ তৈরি তালিবানদের
আরও পড়ুন
মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সমকামীদের পাশে আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক
তবে ক্যানভাস কিংবা কাগজের বদলে দেওয়ালকেই নিজের শিল্প প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ৩৩ বছর বয়সী আফগান শিল্পী। বিশ্বাস, কাগজে কিংবা ক্যানভাসে আঁকা ছবির জায়গা সংগ্রহশালা কিংবা প্রদর্শনী; এবং তা কেবলমাত্র সমাজের মুষ্ঠিমেয় বুদ্ধিজীবী মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বদলে, গ্রাফিটি বা দেওয়ালচিত্র সকলের জন্য উন্মুক্ত। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই ২০১০ সালে প্রথম কাবুলের পথে স্প্রে-পেইন্ট নিয়ে লড়াইতে নেমেছিলেন শামসিয়া। হ্যাঁ, লড়াই-ই বটে। কারণ, বিগত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে আফগান মহিলাদের অধিকার, দাবি-দাওয়া এবং যন্ত্রণার কথাই তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন নিজের শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে নতুন দিনের রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি।
শামসিয়ার এই অভিনব প্রতিবাদ নজর কেড়েছিল গোটা বিশ্বেরই। ভারত, জার্মানি, ইরান, সুইজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের বহু দেশেই প্রদর্শিত হয়েছিল তাঁর আঁকা দেওয়ালচিত্র। আর সেসব ছবির জোরালো কণ্ঠস্বর, একটু একটু করে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করিয়ে দিয়েছিল আফগান মহিলাদের।
কাবুল পতনের পর যখন বিশ্বের প্রথম সারির শক্তিধর দেশগুলি কুলুপ এঁটে রয়েছে, তখনও যুদ্ধে নেমে নির্ভিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন আফগানিস্তানের প্রথম মহিলা গ্রাফিটি আর্টিস্ট। সঙ্গবদ্ধ করেছিলেন আফগানিস্তানের মহিলামহলকে। পরিণতি কী হতে পারে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন তিনি নিজেও। তবে নিশ্চুপে সকলের অজান্তেই যে তাঁকে শিকার হতে হবে তালিবানের, তা যেন মেনে নিতে পারছেন না কেউ-ই। তিনি আত্মগোপন করে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, সেই তত্ত্বও সামনে এনেছেন অনেকে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কিছুই। তাঁর ছবির মতোই যেন রহস্যের ধোঁয়াশা মিশে থাকল এই অন্তর্ধানে…
Powered by Froala Editor