১৮৫৭। সিপাহি বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে দেশজুড়ে। স্বয়ং মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহও জড়িয়ে পড়েছেন পাকেচক্রে। তবে ব্রিটিশ সামরিক শক্তির হাতে এই বিদ্রোহ পরাভূত হতে বেশি সময় লাগেনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে শাসনক্ষমতা চলে যায় ইংল্যান্ডেশ্বরী রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে। আর দেশীয় রাজাদের হাতে যেটুকু নূন্যতম ক্ষমতা ছিল, সেটুকুও বাজেয়াপ্ত হয়। বিচারে মৃত্যুদণ্ডও হয় অনেকেরই। অনেকে আবার ব্রিটিশের বেতনভুক হয়ে কাটিয়ে দিলেন বাকি জীবন।
এরপর আরও ২৫ বছর কেটে গেছে। ১৮৮১ সালে সরকারের কাছে জমা পড়ল একটি আবেদনপত্র। মোঘল শাহজাদা ফিরোজ শাহের বিধবা স্ত্রী আবেদন করেছেন কিছু অর্থসাহায্য চেয়ে। আবেদনপত্র দেখে সরকারি কর্মচারী লিখে দিলেন ‘মাসিক পাঁচটাকা মঞ্জুর’। ব্রিটিশ সরকারের দেয় মাসহারার পরিমাণ সাধারণত বেশ মোটা অঙ্কেরই হত। সাধারণ সিপাহিরাই পাঁচ-সাতটাকার কম পেতেন না। মারাঠা দ্বিতীয় বাজিরাও পেশোয়া তো পেতেন বছরে আট লক্ষ টাকা। হাজার টাকার উপর বেতন পেতেন, এমন রাজার সংখ্যাও কম ছিল না। সেখানে পাঁচটাকা বেতন রীতিমতো কম। ব্রিটিশ কর্মচারী সম্ভবত ফিরোজ শাহের নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। অবশ্য তাঁকে দোষ দেওয়া চলে না। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তাঁর নাম প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে। কোথাও কোথাও তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া গেলেও, বিশেষ কিছু সেভাবে জানা যায়নি। তবে যেটুকু জানা গেছে, সেটুকুও বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে বৈকি।
মোঘল সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের বংশধর ফিরোজ শাহ। তাঁর বাবার নাম নিজাম বখত। সিংহাসনলাভ করেননি কোনোদিন, কিন্তু তাঁর চালচলনে রাজরক্তের প্রকাশ ঘটত সবসময়ই। দিল্লির সিংহাসনে তখন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ। সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে, পায়রা উড়িয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ফিরোজ শাহ কিন্তু এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। সবসময় শুধু ভাবতেন, কীভাবে ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা যায়। সেই সুযোগও এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি। ১৮৫৭ সালের মে মাস, সিপাহি বিদ্রোহের আগুন যখন জ্বলে উঠল। ফিরোজ শাহ তখন মক্কায় হজ করতে গিয়েছেন। খবর পেলেন বোম্বাই ফিরে।
ইতিমধ্যে সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে গ্রেপ্তার করে রেঙ্গুনে পাঠানো হয়েছে। তাঁর সন্তানদের খুন করেছে ব্রিটিশরা। ফিরোজ শাহ কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে সীতামৌ আক্রমণ করলেন। তারপর মান্দাসার। মান্দাসারে সমস্ত মুসলমান ও রক্ষণশীল হিন্দুদের একজোট করে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। দুই ধর্মের সিপাহীরাই সাড়া দিলেন তাঁর ডাকে। তাঁকে বিদ্রোহের নেতা বলে মেনে নিলেন সবাই। দেখতে দেখতে সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ালো ১৭-১৮ হাজার। অনেক দেশীয় রাজার সঙ্গেও মৈত্রী চুক্তির চেষ্টা করলেন ফিরোজ শাহ। তবে এভাবে বেশিদিন চলল না। ডুরান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরই তাঁর সৈন্যসংখ্যা কমতে থাকে। ফিরোজ শাহ এবং তাঁর দুই সহযোগী তাঁতিয়া তোপি ও পান্ডুরঙ্গ সদাশিব রাও, তিনজনের মিলিত সৈন্যসংখ্যাও দুহাজার হবে কিনা সন্দেহ।
এরকম পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের মধ্যে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকলেন তাঁরা। কিন্তু একসঙ্গে থাকা নিরাপদ নয় বুঝে তাঁরা আলাদা হয়ে গেলেন। এরপর মানসিংএর বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়েন তাঁতিয়া তোপি। সদাশিব রাওয়ের পরিণতিও তাই হয়। তবে ফিরোজ শাহ কিন্তু ব্রিটিশের হাতে ধরা দেননি। বিদ্রোহের সূত্রপাতে একদিন আরব থেকে বোম্বাই এসে পৌঁছেছিলেন। পরাজিত ফিরোজ শাহ আবার ফিরে গেলেন আরবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। প্রবল দারিদ্র্যে, অনাহারে অর্ধাহারে কেটেছে শেষ জীবন। কিন্তু রাজত্ব পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন ছাড়তে পারেননি।
১৮৭৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবিত থাকার খবর জানা যায়। তারপর মক্কা শহরেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। দেশত্যাগের পর আবদার রহমান নামে এক আরব প্রবাসী ভারতীয়ের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন ফিরোজ শাহ। ১৮৮১ সালে সেই বিধবা 'বেগম'ই সরকারের কাছে অর্থসাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। তার পরিণতি কী হয়েছিল, সেকথা আগেই বলেছি। তবে, বড়লাট লর্ড রিপনের চোখে পড়েছিল সেটা। দেখামাত্র তিনি মাসোহারা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করেছিলেন। কিন্তু এসবের মধ্যে বিস্মৃতির অতলে ফিরোজ শাহ। সিংহাসন পুনর্দখলের স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন
মোঘল সম্রাটের পর করোনা; এবারের মতো স্থগিত পুরীর রথযাত্রা, নির্দেশ কোর্টের
তথ্যসূত্র: ইতিহাসের গল্প, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
বাহাদুর শাহ জাফর অ্যান্ড দ্য ওয়র অফ ১৮৫৭ ইন দিল্লি, সৈয়দ মুহদি হাসান
Powered by Froala Editor