বাইরে অঝোরধারায় বৃষ্টি, ভিতরেও। ছাঁট এসে পড়ে ঘরদুয়ারে, মনবারান্দায়। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। বয়স কতই-বা আর! বড়োজোর ২১। নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল। এই বয়সেই। যে গাড়িটা তাঁকে নিয়ে এসেছে শিমুলতলার নিরালা বাসস্থানে, সেই গাড়িটাও তো বাইরে একা। মেয়েটির মতোই। এই পাহাড়ি পরিবেশের পাঁচিলঘেরা উঠোনে হোক, কিংবা কলকাতার পুরনো বাড়িটায়। কোনটা ঠিক? কোনটা ভুল? আদৌ কি সংজ্ঞা হয় ঠিক-ভুলের? প্রশ্নের অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে মেয়েটি। আর ইন্দ্রাশিস আচার্যের (Indrasis Acharya) সিনেমা ‘নীহারিকা’-য় (Niharika- In the mist) দূর ছায়াপথে জমে থাকা বিষণ্ণতার পুঞ্জীভূত মেঘেরা ঢুকে পড়ে দর্শকের অস্তিত্বে।
এই ছবি মুক্তির পর পেরিয়ে গিয়েছে ৭ সপ্তাহ। বড়ো বাজেটের বাংলা ছবির পক্ষেও এই সময়টা কম সময় নয়। ‘নীহারিকা’ সেখানে একটি স্বাধীন ছবি। বড়ো টাকার বিনিয়োগ নেই এখানে। বিনোদনে ঠাসা কাহিনিচিত্র নেই। নেই টানটান থ্রিলারের উত্তেজনা। এদিকে শনিবার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। ঝমঝমে বৃষ্টি কলকাতাজুড়ে। তারপরেও নন্দনের প্রায় ৯০ শতাংশ আসন ভর্তি। কীসের আকর্ষণে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন প্রেক্ষাগৃহে? কেন সেই অর্থে কোনো প্রচারের মোড়ক ছাড়াও নীহারিকার মতো ছবি আজও চলছে, সেটা বোঝার জন্যই যাওয়া ছবি মুক্তির ৭ সপ্তাহ পরে। এটা কতটা সমালোচনা জানি না। প্রথাগত সমালোচনার রীতি তো ভাঙা হলই। আবার, প্রথা ভেঙেই এই ছবি এতদিন চলছে। প্রথা ভেঙেই এই ছবি বানিয়েছেন ইন্দ্রাশিস। তাই পুরোটাই এক জায়গায় মিলল নাহয়।
মেয়েটির নাম দীপা (অনুরাধা মুখোপাধ্যায়)। কলকাতার এক পুরনো বাড়িতে মায়ের সান্নিধ্যে কেটেছে মেয়েবেলা। মদ্যপ, সন্দেহপ্রবণ বাবার অত্যাচারের ক্লেদাক্ত অভিজ্ঞতার পাঁক মেখেই বড়ো হয়ে ওঠা। কখনও বা শ্বাপদের মতো গন্ধ শুঁকে এসে হাজির হয়েছে পরিবারেরই কোনো সদস্য। হানা দেয় যৌনহেনস্থার গ্লানি। মায়ের চিরমুক্তির পর শিমুলতলায় ছোটোমামার (শিলাজিৎ মজুমদার) আশ্রয়ে প্রথমবার নিজের সঙ্গে একলা থাকার সুযোগ পায় দীপা। কিন্তু ফেলে আসা অতীত আর সামাজিক গণ্ডি বহির্ভূত সম্পর্কদের নৈঃশব্দ্যের বিবরে বন্দী থাকা যেন পর্যায়ক্রমিক ভবিতব্য হয়ে ওঠে। ‘বিকৃত’ ভালোবাসার দায়ে গুমরে ওঠে সর্বস্ব। জীবন আর স্বাধীনতার উত্তর খোঁজার এই গল্পই ‘নীহারিকা’-র উপজীব্য।
তাই বোধহয় বারবার শিমুলতলায় ফিরে যাওয়া। যেখানে মোবাইল নেই, ইন্টারনেট নেই। লোডশেডিং-এর আঁধারে জ্বলতে থাকে টিমটিমে হ্যারিকেন। ধোঁয়াশা ঘেরা মানবচরিত্রের প্রতিটা পরত উন্মোচনের আদর্শ পরিবেশ। সিনেমার মূল কাহিনি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভয়’ উপন্যাসের আধারে নির্মিত। যেখানে সময়কাল ছিল আশির দশক। সেটিকে ২০২৩-এর প্রেক্ষাপটে নিয়ে এলেও পরিচালকের চোখে শিমুলতলা যেন টাইম মেশিনে করে পৌঁছে যাওয়ার জায়গা। জঙ্গল আর ঝরনায় সাজানো পাহাড়ি দেশ। প্রায় জনবসতিশূন্য। সেখানে না গেলে দীপা খুঁজে পেত না নিজেকে। কলকাতার ওই পুরনো, মৃত বাড়িটায় বহু আগেই নিথর হয়ে যেত তাঁর সত্তা।
আরও পড়ুন
তেজস্ক্রিয় আবর্জনা ও একটা সিনেমা – দোস্তজী
‘বিলু রাক্ষস’, ‘পিউপা’, ‘পার্সেল’-এর পর এটি ইন্দ্রাশিসের চতুর্থ ফিচার সিনেমা। বিলু রাক্ষসের কেন্দ্রে একটা বাড়ি ছিল। যে বাড়ি নিজে হয়ে উঠেছিল বিলুর অন্তর্নিহিত হাহাকার, তার ক্রমশ রাক্ষস হয়ে ওঠা, তার শুন্যতা, রূপান্তরের প্রতিকৃতি। ‘পিউপা’-তেও ফিরে এসেছে উত্তর কলকাতার এক বাড়ির একাকিত্ব আঁকড়ে টিকে থাকার দৃশ্যপট। নীহারিকাও আসলে একটা বাড়ির নাম। এই ছবিতেও প্রতিটা দৃশ্যপট হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র চরিত্র।
আরও পড়ুন
পাঁচ বছর পর প্রত্যাবর্তন ‘বিলু রাক্ষস’-এর, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত চিত্রনাট্য
‘বিলু রাক্ষস’ বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের ধাক্কা দিয়েছিল। এই সিনেমা যিনি তৈরি করেছেন, তিনি চলচ্চিত্রের ভাষা জানেন। ‘পিউপা’, ‘পার্সেল’-এও সেই একই ধারাবাহিকতা। ‘নীহারিকা’-ও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে পরিচালক যেন এখানে আরও পরিণত। আখ্যানের নির্মাণে আরও বহুস্তরিক, প্রাণবন্ত।
এই সিনেমায় দৃশ্যপটেরও নিজস্ব গল্প রয়েছে। বিহারের শিমুলতলা, বাঙালির স্বাস্থ্য উদ্ধারের পুরনো ঠিকানা। আশির দশকের প্রেক্ষাপটে শিমুলতলাকে একভাবে ধরতে চেয়েছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সময় বদলে যায়। কিন্তু থেকে যায় শিমুলতলার গল্পগুলো। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, নির্জন মাঠের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে একটি গাড়ি। অথচ গাড়ি তো সোজাও যেতে পারত। এই দৃশ্যও যেন এক সংকেত। দীপার মনের গতি যেখানে সরলরেখায় চলে না, গাড়িটির গতিও যেন সংকেতে মিলে যায় দীপার সঙ্গে। আর মনের গহীনের এই চলাচলের সাক্ষী হয়ে থেকে যায় শিমুলতলার মাঠ। চিত্রগ্রাহক শান্তনু সেন পরম যত্নে ফুটিয়ে তুলেছেন শিমুলতলার নিজস্ব গল্পকেই।
সভ্যতার নিস্তরঙ্গ স্রোতের মতো তিনটি ঋতুতে এগিয়ে চলে ক্যামেরা। ধরে রাখে অনেক ছোটো ছোটো মুহূর্ত। একটি দৃশ্যে পাহাড়ি রাস্তার বাঁক ধরে এগিয়ে যায় দুটি গাড়ি। একসময়ে ভিন্ন হয়ে যায় দুটি পথ। স্থির ফ্রেমের সঙ্গে জীবনের প্রবাহমানতা মিশে তৈরি করে গভীর ব্যঞ্জনা। আবার কলকাতার বাড়িতে চলে আলো-আঁধারের রহস্য। সমস্ত বাড়িটা জুড়েই একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। শব্দের কলতানও বড়ো সংযমী পুরো সিনেমায়। নিস্তব্ধতার মাত্রায় ছুঁয়ে দেখে দর্শকের হৃদয়ের অতল স্পর্শ। শুধু ঝরনার শব্দের জন্যই মনে থেকে যায় একটি দৃশ্য।
আসলে কোনো অপ্রয়োজনীয় চমকের দিকে ঝোঁকেন না পরিচালক। কাহিনির চড়াই-উতরাই নেই। নেই কোনো আকস্মিক অভিঘাতও। বরং মানবমনের টানাপোড়েনে যে অভিঘাত তৈরি হয়, সম্পূর্ণ সিনেমাটি জুড়েই তা এগিয়ে চলে ধারাবাহিকভাবে। দীপার অন্তরের আঁধারে জমে থাকা কথারাই তো সব। যার মাঝে অসীম নীরবতা। সংলাপের মধ্যেও যেন শোনা যায় সেই দ্বিধার শব্দ। সংলাপের উচ্চকিত মুহূর্তগুলিতে ক্যামেরাকে রাখেন দর্শকের নাগালের বাইরে। ঘরের ভিতরে চলে তুমুল অশান্তি। দৃশ্য দাঁড়িয়ে থাকে দরজার বাইরে। দীপার মায়ের মৃত্যুর অংশ বা শেষের একাধিক শোকাবহ মুহূর্তে আবেগের রাশ টেনে ধরে আরও বিচলিত করে দর্শককে। তবে অদ্ভুত অস্বস্তি জাগায় মৃত্যুপথযাত্রী দীপার দাদুর পাশের বিছানায় উদ্দাম যৌনতায় সিক্ত দুটি নারীদেহের দৃশ্যটি।
অথচ দীপার মনে কামনাকে ‘বিকৃত’ ভাবার প্রশ্নটি এসেছে অনেক পরে। হয়তো নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়েই। দীপার চরিত্রে অনুরাধা মুখোপাধ্যায়ের প্রতিটি দৃষ্টিক্ষেপে ধরা পড়ে সেই অব্যক্ত কথাদের জটিলতা। ধীর, নাটকীয়তাহীন উচ্চারণে ক্রমশে উপরিতলে উঠতে থাকে তার প্রশ্নগুলি। জীবন কী? স্বাধীনতা কী? শেষ পর্যন্ত যে স্বাধীনতার আস্বাদ সে পায়, তার পরিণতি নিয়েও কিন্তু থেকে যায় প্রশ্ন। ছোটোমামা চরিত্রে শিলাজিৎ যে নির্ভরতার মাপকাঠি তৈরি করেন, আমরা প্রত্যেকে খুঁজি সেই আশ্রয়স্থলটি। কিন্তু অন্তহীন সহানুভূতি ছাড়া তার জন্য কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। চাওয়া-পাওয়ার মাঝে তৈরি হয় দুস্থর ব্যবধান। সম্পর্কের এই দূরত্বকেই শুধু চোখের চাহনিতে আগলে রাখেন ‘ছোটোমামি’ মল্লিকা মজুমদার। তাদের জটিলতার প্রসঙ্গটি আরও আগেই হয়তো আনা যেত। মুগ্ধ করে সংক্ষিপ্ত পরিসরেও অনিন্দ্য সেনগুপ্তের রঙ্গন চরিত্রটির পরিধি।
দীপার জীবনে এভাবেই একের পর এক চরিত্র আসতে থাকে, এসে চলেও যায়। একাধিক দৃশ্যে বারবার দেখা যায়, ফ্রেমের মধ্যিখানে একা দাঁড়িয়ে দীপা। অন্য চরিত্ররা ফ্রেমের বাইরে থেকে আসে, কথা বলে, আবার ফ্রেমের বাইরে চলে যায়। নিয়ত যাতায়াতের এই চিত্ররূপ কখনও ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে না। এখানেই ধরা পড়ে সম্পাদক লুব্ধক চ্যাটার্জির নৈপুণ্য। পরিচালকের চাহিদার সঙ্গে সমানভাবে সঙ্গত করে গিয়েছেন তিনি। তেমনই নৈপুণ্যের সঙ্গে ধরেছেন প্রতিটা দৃশ্যপটকেও। এখানে এক একটি ওয়াইড শটের দৈর্ঘ্য বর্তমানের স্বাভাবিক নিয়মের চেয়ে যেন অনেকটাই বেশি। ক্যামেরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্রেমের মধ্যে ধরা থাকে শূন্যতা। দৃশ্যপট যে নিজেই এখানে চরিত্র। তাই তার আত্মপ্রকাশের সময়টুকু দিতে হবেই। পরিচালক-সম্পাদকের অনুরণনে এই ট্রিটমেন্ট এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় সিনেমাটিকে।
দীপার নিয়তিই তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিটি চরিত্রকে। শিমুলতলায় যে জীবনের স্বপ্ন স্পর্শ সে পেয়েছিল, তাও পালিয়ে যায় হাতের মুঠো গলে। আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসায় একটা যন্ত্রণা আছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলে মানুষ। আর যে চায় নিজেকে খুঁজতে, জীবনের সংজ্ঞাকে একবার পরখ করে দেখতে, তার জন্য বরাদ্দ থাকে বেদনা। দীপা প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে। পায়নি। কেউই বোধহয় পায় না। সকলেই নীহারিকার মতো ভাসতে থাকে মহাকাশের কোণে। একলা... সঙ্গীবিহীন...
Powered by Froala Editor