বিভূতিভূষণের উপন্যাস আর সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি, দুয়েরই নাম ‘পথের পাঁচালী’। অনীক দত্তের ছবি ‘অপরাজিত’-র নায়ক অপরাজিত রায়ের সৃষ্টির নাম ‘পথের পদাবলী’। এই ‘পদাবলী’ শব্দটিতে লৌকিক আখ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সংগীতের চলন, ঠিক যেমন সত্যকে জয় করা এক গভীর সৃজনশীল মানুষের ‘অপরাজিত’ হয়ে ওঠার মধ্যে থাকে নিরন্তর লড়াইয়ের ইশারা। এক কথায় বলতে গেলে, তাঁর ছবিতে খুব সূক্ষ্ম অথচ সার্থকভাবে যেন এক সৎ শিল্পীর নিরন্তর স্বপ্ন, শ্রম আর সাধনের সঙ্গে আমাদের ধীরে ধীরে জড়িয়ে নেন পরিচালক অনীক দত্ত। সেখানে তিনি ইতিহাসের প্রতি, সত্যজিতের জীবনের প্রতি বিশ্বস্তভাবে অনুগত থেকেও একটি সর্বকালের আখ্যান রচনা করেন; ছবি নির্মাণের শর্তে পরিবর্তিত মূল নামগুলিই তখন হয়ে ওঠে এই ছবির ধ্রুপদী ব্যঞ্জনার প্রতীকগুচ্ছ। এমনকি এই ছবিতে সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ (Aparajito) নামটির ডাকনাম ‘অপু’ এক অন্য ব্যঞ্জনা দেয় কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে।
পাঁচালি বা ‘পদাবলী’-র মধ্যে যে কথকতার ভঙ্গি আছে, তার সঙ্গে সাম্য রচনা করে এক আধুনিক ন্যারেটিভ স্টাইল ব্যবহার করেন পরিচালক। পুরো ছবিটাই সত্যজিৎ রায়ের(এখানে অপরাজিত রায়) সঙ্গে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বেতার-আলাপচারিতার সূত্র ধরে এগিয়ে চলে। অল ইন্ডিয়া রেডিও-র লোগো-সাঁটা মাইক্রোফোনটি এই আলাপচারিতার শটগুলিতে ফ্রেমের কেন্দ্রে থাকে কখনো কখনো, এক অমোঘ প্রতীকের মতো। অপরাজিত রায়ের বয়ান থেকে আমরা চলে যাই আখ্যানের বিশ্বস্ত দৃশ্যায়নে, আর আকাশবাণী থেকে সরাসরি প্রচারিত এই আলাপচারিতা যখন স্বপ্নের সঙ্গে সত্যের আশ্চর্য সংযোগ তৈরি করে, আবহে বেজে ওঠে ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু’। সেই মুহূর্তে শিল্পের সত্যের সঙ্গে বাস্তবের বিরোধ দ্রব হয়ে যায়, আমরা ছবিতে উচ্চারিত, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাদর্শনের অতীব প্রিয় নিও-রিয়ালিজমকে অনীকের ছবিতেও প্রত্যক্ষ করি; আর সেইসঙ্গে যুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীর একটি সদ্য-স্বাধীন বিরাট উপনিবেশের মাটিতে কলকাতা শহরের একটি স্বপ্ন-দেখা যুবকের সঙ্গে বোড়াল গ্রামের টাকমাথা মানুষ, বিভূতিভূষণের দেখা গ্রামজীবনের অতল রোদন আর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণের সংবেদন মিলেমিশে যায়।
আর সেখানেই ছবিটি আমাদের এই নিরন্তর দুঃস্বপ্নময় সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে একটা ‘স্বপ্ন-দেখা’ গোপন আমিকে ছুঁয়ে দেয়, একটা সার্থক বৃষ্টির দৃশ্য রচনা করার শ্রম ও আনন্দ তখন 'আমাদের’ নিজস্ব হয়ে ওঠে।
অথচ ‘অপরাজিত’ নামের দীর্ঘকায় সুদর্শন ‘নায়কে’র রূপ থেকে আমাদের চোখ সরে না (সোমনাথ কুন্ডুর প্রস্থেটিক রূপসজ্জায় জিতু কমলের চুম্বকীয় স্ক্রিন প্রেসেন্স আর ডাবিং-এ চন্দ্রাশিস রায়ের ঘন ব্যারিটোন আমাদের আবিষ্ট করে রাখে), আমরা অপরাজিত রায়কে ভালোবাসতে শুরু করি। আমাদের চারপাশের নিত্যকার খর্বতার বিপরীতে সেই উচ্চতাকে অনুভব করতে শুরু করি। অনীক আমাদের অপরাজিত রায়ের জীবনের সঙ্গে স্বপ্নের সঙ্গে, এমনকি দুঃস্বপ্নের সঙ্গেও একাত্ম করে নেওয়ার সুচারু কাজটি করে নিতে থাকেন। আর সেই সঙ্গে এই ছবির সাদা-কালো রঙের মায়া বাস্তবতার এক অন্যতর মাত্রা তৈরি করে চলে।
আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সোমবারের দুপুর, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও সত্যজিৎ-ছায়া
এই সমস্ত ন্যারেটিভটার সঙ্গে মিশে থাকে সত্যজিতের বিলেতে শেখা স্টোরি বোর্ডের উল্লেখ ও ব্যবহার, শান্তিনিকেতনের, বিশেষ করে সত্যজিতের শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের থেকে শেখা সামান্য রেখায় রিয়ালিটি রচনার রেফারেন্স, ১৯৪৭ সালে তৈরি ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে কম্যুনিজমের সম্পর্কের কথা, সময়ের প্রতীকী রেফারেন্স হিসেবে রুশ বিপ্লব বা ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’-এর উল্লেখ— সব কিছুই বোনা হয় এক নিটোল কথকতার ভঙ্গিতে। আর মূল ভাবনা ও প্রাথমিক গবেষণার কাজটি খুবই উঁচুমানের এই ছবিতে।
আরও পড়ুন
একুশে ফেব্রুয়ারির সত্যজিৎ
ভালো লাগে, সত্যজিতের শিল্পজীবনে বিজয়া রায়ের মেধাবী উপস্থিতি খুব সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপিত করা। সেই চরিত্রে(এখানে বিমলা রায়) খুব সপ্রতিভ অভিনয় করেছেন সায়নী ঘোষ। আর ভালো লাগে সুব্রত মিত্র, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, দুলাল দত্তের মতো অসামান্য শিল্পীদের এই প্রজন্মের সামনে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা। আলাদা করে ভালো লাগে অনসূয়া মজুমদার এবং রিচার্ড হ্যারেটের স্বাভাবিক অভিনয়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যেখানে সিনেমাপাড়ার দৃশ্যে পোস্টারে কানন দেবীর মুখও ডিটেলিং-এ থাকে, থাকে মানিকের (‘পথের পাঁচালী’র অপু) মাথার অবিকল রাংতার মুকুট বা ননীবালার সাদা-কালো খোপ খোপ চাদর, সেখানে সর্বমঙ্গলার কুঞ্জলতা পাড়ের সেই অনুপম মলিন শাড়ির বদলে এক ফ্যাটফ্যাটে সাদামামুলি পাড়ের শাড়ি কেন? প্রশ্ন জাগে, সত্যজিৎ রায় কি শিশুশিল্পীর মুখের সামনে বা চুনীবালা দেবীর সামনেও সিগারেট খেতেন? বা বিধান রায়ের মতো ব্যক্তিত্বের সারশূন্য নেতাটির মতো একমাত্রিক কমিক বয়ান?
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায় নামাঙ্কিত চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে চলেছেন মার্টিন স্করসেস এবং ইসৎভান জাবো
কিন্তু এই সব ত্রুটি গৌণ হয়ে যায় এই ছবির সাংগীতিক বিন্যাসের পাশে। ছবির ভাষা ও টেকনিককে তীব্র সংবেদন দিয়ে বোঝেন বলে, দেবজ্যোতি মিশ্র এরকম অলৌকিক সংগীত রচনা করতে পারেন এই ছবিতে। সত্যজিৎ যেমন ‘পথের পাঁচালী’-তে দেশীয় মার্গ এবং লোকসংগীতকে শিকড়ের শক্তি নিয়ে প্রয়োগ করিয়ে নেন পণ্ডিত রবিশংকরকে দিয়ে, অথচ কোন জাদুমন্ত্রে তার মধ্যে থেকে যায় অর্কেস্ট্রার হারমনি, তেমনি দেবজ্যোতি তাঁর নিজস্ব মৌলিক সৃজনে এই ছবিতে রাগরাগিণীর সঙ্গে কখনো সিক্সথ সিম্ফোনি, রবীন্দ্রনাথের গান এবং সব মিলিয়ে একটা নিও-পাস্তোরাল স্থাপত্য রচনা করেন। তাঁর তৈরি বৃষ্টির আবহে চোখ ভিজে আসে, আর তাঁর রচিত স্বপ্নদৃশ্যের কম্পোজিশনে অবচেতনের স্বরকে যেন তুলে আনেন দেবজ্যোতি, সেখানে এক শিল্পীর ভেতরের আশাতৃষাদাহ সব যেন ভাষা পায়। ছবিতে মাটির খেলনাগাড়ি থেকে রেলগাড়ির শব্দের মধ্য দিয়ে অনন্ত চলার দৃশ্য ও শ্রাব্য স্বরূপ মিলেজুলে যায়। আমাদের মনে পড়ে যায় এই ছবির আভাসে রবীন্দ্রনাথ নামে আরেক আইকনের ইঙ্গিতবহ উপস্থিতির কথা, বিশেষত ছবির অন্তিম অংশে শ্রমণা চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’ গানের আবহে, যে গানে বিজয়া রায়ের দিদি সতী দেবীর গাওয়া বিখ্যাত রেকর্ডিং-এর ছায়া এসে পড়ে একজন শিল্পীর যথার্থ অর্থে ‘অ-পরাজিত’ হয়ে ওঠার লগ্নে।
বহুদিন পরে, রেশ নিয়ে থাকার মতো, একটা বাংলা ছবি পেলাম। এ বড়ো ভরসার, বড়ো আরামের কথা।
Powered by Froala Editor