জীবনে আস্থা ফেরাতে হাতিয়ার চলচ্চিত্র উৎসবও, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ‘প্রত্যয়’-এর

আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। তাই গতকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রস্তুতি। ঘর সাজানো, পোস্টার তৈরি, যত্ন নিয়ে রঙ্গোলি রাঙিয়ে তোলা— এইসব কিছুরই আয়োজন চলছিল পুরোদমে। 

‘প্রত্যয়’ (Pratyay)। বলতে গেলে, লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালের ঠিক উল্টোদিকে অবস্থিত এই ভবন এক স্বপ্নরাজ্য। রাজ্য সমাজকল্যাণ দপ্তরের নির্মিত এই জীবন সহায়তা কেন্দ্র বাঁচার স্বপ্ন দেখায় মানসিক হাসপাতাল থেকে ফেরত আসা মানুষদের। বাঁচতে শেখায় নতুন করে। আর তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসংস্থা কিংবা তাঁদের পরিবারের মধ্যে সেতুস্থাপনের কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী মানসিক স্বাস্থ্য সংগঠন ‘অঞ্জলি’। পথ দেখায় ক্ষমতায়নের। ‘প্রত্যয়’-এ থেকেই কেউ নতুন করে শুরু করেন ছবি আঁকা, গান শেখানো, পুতুল তৈরি কিংবা রান্না করা, কেউ আবার বাড়ি ফিরে যোগ দেন কর্মক্ষেত্রে। শুরু করেন নিজস্ব ব্যবসা। এই স্বপ্নের বাড়িতেই এবার আয়োজিত হল এক ভিন্ন স্বাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর আসর। 

না, নাচ-গান, কবিতাপাঠ, শ্রুতিনাটক কিংবা মঞ্চাভিনয় নয়। বরং, আস্ত একটি চলচ্চিত্র উৎসব। সিনেমাকে পাথেয় করেই আজ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত চলবে তিনদিনব্যাপী এই রবীন্দ্র-উদযাপন। প্রতিদিন দেখানো হবে তিনটি করে সিনেমা। 


“মূলত আবাসিকদের উদ্যোগেই এই উৎসবের আয়োজন। তাঁরাই ‘প্রত্যয় চলচ্চিত্র উৎসব’-এর (Pratyay Film Festival) কিউরেটার। কিছুদিন অন্তর অন্তর রেসিডেন্টদের জন্য কিছু না কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা করি আমরা। সেরকমভাবেই এই চলচ্চিত্র উৎসবের কথা চিন্তাভাবনা করেছেন ওঁরা”, বলছিলেন ‘অঞ্জলি’ মানসিক স্বাস্থ্য সংগঠনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক অভিজিৎ রায়। 

তাঁর থেকেই জানা গেল, এই গোটা আয়োজনের নেপথ্যে রয়েছেন ‘প্রত্যয়’-এর তিন আবাসিক সৌগত চৌধুরী, অনির্বাণ পাল এবং কোয়েল চক্রবর্তী। শুধু আয়োজন, ব্যবস্থাপনা কিংবা অতিথিদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানোই নয়, কোন কোন সিনেমা দেখানো হবে তিন দিনের এই চলচ্চিত্র উৎসবে— সেটাও ঠিক করেছেন তাঁরাই। সেখানে যেমন জায়গা পেয়েছেন ‘তিন কন্যা’-র প্রথম ছবি ‘পোস্টমাস্টার’, ‘জনঅরণ্য’, ‘সহজ পাঠের গপ্পো’, ‘মহানগর’-এর মতো বাংলা সিনেমা, তেমনই রয়েছে ‘ডিউন’ কিংবা ‘দ্য ব্যাটম্যান’-এর মতো পাশ্চাত্যের ছবিও।


অভিজিৎ জানালেন, “বায়ো-মেডিক্যাল ফর্মুলায় যেভাবে অসুখ সারানোর কথা বলা যায়, তার বাইরে বেরিয়ে আমরা চেষ্টা করি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কীভাবে খুব সহজভাবে একটা আলাপ, পরিবেশ গড়ে তোলা যায়। তাই আজ পর্যন্ত প্রত্যয়ে যত অনুষ্ঠান হয়েছে তার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমরা সম্পূর্ণভাবে আবাসিকদের ওপর ছেড়ে দিই।”

এই সূত্র ধরে উঠে এল ড্রামা থেরাপি, মিউজিক থেরাপির প্রসঙ্গও। ভুল ধরিয়ে দিলেন অভিজিৎ। আসলে এই ধরনের থেরাপির উদ্দেশ্য সংযোগের সেতু স্থাপন করা হলেও, ‘থেরাপি’ শব্দটা এই উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় মোটেই। তাঁর কথায়, “হাসপাতাল থেকে ফেরার পর যাঁরা ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিক, তাঁদের স্বাভাবিক নাগরিক হিসাবেই মনে করার চেষ্টা করি আমরা। ফলে, এর মধ্যে বিভিন্নরকম থেরাপিউটিক কম্পোনেন্ট, এলিমেন্ট থাকলেও সাধারণ মানুষের ওয়েলবিয়িং-এর জন্য যে সেশনের দরকার, এটা তেমনই একটি সেশন।”

তবে সত্যিই কি সাধারণ এই আয়োজন, এই চলচ্চিত্র উৎসব? না, তা একেবারেই নয়। বরং, প্রত্যয়ের এই চলচ্চিত্র উৎসব প্রথম দিনেই তৈরি করল এক আশ্চর্য দৃশ্যপট। আবাসনের আবাসিকরা এই চলচ্চিত্রগুলির সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন নিজেদের, কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গ্রহণ করতে পারবেন— তা নিয়ে সংশয় ছিল আয়োজকদের। সংশয় ছিল ‘অঞ্জলি’-র কর্মীদেরও। তবে উৎসবের প্রথম সিনেমা ‘পোস্টমাস্টার’ শেষ হওয়ার পরেই কেটে যায় সেই আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ। আবাসিকরা মনোযোগ সহকারে ছবি দেখেছেন তো বটেই, সিনেমা শেষ হওয়ার পরে আয়োজকদের সঙ্গে রীতিমতো আলোচনাও জমে উঠেছিল দর্শকদের। পোস্টমাস্টার পড়া, গল্প শোনা এবং সেই গল্পের চলচ্চিত্রায়ন কীভাবে আলাদা একে-অপরের থেকে— সেই বিশ্লেষণাত্মক জায়গাটাই উঠে আসে আবাসিকদের পারস্পরিক আলোচনায়। আর পাঁচটা চলচ্চিত্র উৎসবে যা দেখা যায় না কখনোই। সবমিলিয়ে এই আয়োজন যেন সেতুবন্ধন করছে সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চাওয়া মানুষগুলোর অন্তরাত্মার মধ্যে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More