যুগে যুগে মসীহারা ঘোড়ায় চড়েই এসেছেন। কেউ এসেছেন পক্ষীরাজের পিঠে, কারোর ঘোড়া আবার নিতান্ত সাধারণ। টগবগিয়ে এগিয়ে চলেছে দুর্গম রাস্তা দিয়ে। উপকথার সেইসব গল্পকেই যেন সত্যি করে তুললেন ফিজি দ্বীপের চিকিৎসকরা। এই অতিমারী পরিস্থিতিতে তো তাঁরাই মসীহা। আর মানুষকে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়ার চেয়ে বড়ো কাজ আর কীই বা হতে পারে? দেশের একটি মানুষও যাতে ভ্যাকসিনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন, তাই ঘোড়ায় চেপেই দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকায় রওয়ানা হলেন চিকিৎসকরা। একের পর এক গ্রামে শিবির খাটিয়ে চলল ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ।
মাত্র ৯ লক্ষ মানুষের দেশ ফিজি। অবশ্য ইতিমধ্যে সেখানে করোনা ভাইরাসের ডেলটা স্ট্রেইন বেশ ভালোভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২ মাসে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন ৫০০-র বেশি। এখনও পর্যন্ত ডেলটা স্ট্রেইনে শতকরা হিসাবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ ফিজি। তবু লড়াই ছাড়েননি চিকিৎসকরা। শহরের বুকে তো বটেই, ভ্যাকসিন নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন গ্রামেগঞ্জেও। তবে ছোট্ট এই দ্বীপের অনেক অংশেই কোনো সড়কপথ নেই। সেখানে মানুষের সংখ্যাও খুবই কম। তবু চিকিৎসকরা বলছেন, একজন মানুষকেও ভ্যাকসিনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
মাসখানেক আগে রাজধানী সুভা শহরের সিএমডব্লিউ হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ লোসালিনি তাবাকি হাসপাতালে পৌঁছেই একটা ফোন পেলেন। তাঁকে এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে হবে। নাকিদা অঞ্চলে ভ্যাকসিন নিয়ে যেতে হবে তাঁদের। কিন্তু কীভাবে পৌঁছাবেন তাঁরা? নাকিদা অঞ্চলে যেতে গেলে পাহাড়ের ঢাল পেরিয়ে নদী পেরিয়ে যেতে হবে। মোটরগাড়ি যাওয়ার কোনো পথ নেই। টেলিফোনে উত্তর আসেনি। উত্তর কিছুক্ষণ বাদে এসে হাজির হাসপাতালের সামনে। কয়েকটা ঘোড়া এসে থামল সেখানে। ঘোড়াচালকদের মধ্যে থেকে একজন এসে জানালেন, এই ঘোড়াতেই নাকিদা যেতে হবে তাঁদের।
তাবাকি ও তাঁর সহকর্মীরা ঘোড়ায় চড়লেন। ভ্যাকসিন, কিছু ওষুধপত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জামও ঘোড়ায় তোলা হল। তারপর একটু একটু করে মাঠাঘাট নদী পেরিয়ে এগোতে থাকলেন তাঁরা। পথে খাবার জল শেষ হয়ে যায়, খাবারের বাক্সগুলোও কোথায় রেখেছেন খুঁজে পাননি কেউ। তবু কারোর মধ্যেই কোনো বিরক্তি নেই। চিকিৎসকের দায়িত্ব তাঁরা পালন করতে চলেছেন। এভাবেই নাকিদা অঞ্চলে প্রায় ২০টি গ্রামে ভ্যাকসিনেশন শিবির করে ফিরেছেন তাঁরা। অবশ্য সব জায়গায় মানুষ সমানভাবে তাঁদের গ্রহণ করেননি। অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে ভয় পেয়েছেন। তাঁদের রাজি করানো, তাঁদের ভুল বিশ্বাস বদলানো বেশ কঠিন কাজ। তবে গ্রামের মোড়লরা রাজি হলে বাকিদের রাজি করানোটা সহজ হয়েছে। সেইসব গ্রামে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। অন্যদিকে যেসব গ্রামে মোড়লরা রাজি হননি, সেখানে সংখ্যাটা ৪০-৪৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে জোর করে কাউকে ভ্যাকসিন দেননি তাবাকিরা। আর এই যাত্রা আসলে ভ্যাকসিনের জন্য হলেও অন্য নানা চিকিৎসাও করতে হয়েছে তাঁদের। যেখানে চিকিৎসার নূন্যতম পরিকাঠামোই নেই, সেখানে চিকিৎসকদের হাতের কাছে পেয়ে সহজে বিদায় দিতে রাজি হননি অনেকেই।
আরও পড়ুন
এমবিবিএস পড়েও করতে হবে আয়ুর্বেদ-হোমিওপ্যাথির প্র্যাকটিস! ক্ষুব্ধ চিকিৎসকমহল
তাবাকি এবং তাঁর সহকর্মীদের কাছে এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে, এমনটাই জানিয়েছেন তাঁরা। এরপর আবারও কি কোনোদিন সেখানে যেতে ইচ্ছা হবে না? এই করোনা পরিস্থিতিই যেন চিকিৎসকদের সঙ্গে নাকিদা অঞ্চলের মানুষদের একটা যোগসূত্র তৈরি করে দিল।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের নিয়েই প্যারালিম্পিকের পরিকল্পনা, আয়োজনে এক চিকিৎসক!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সরকারের উদ্যোগেই ৩ লক্ষ শিশু চুরি স্পেনে, যুক্ত ছিলেন চিকিৎসকরাও!