শৈশব থেকেই শুরু লড়াই, একের পর এক প্রতিবন্ধকতা টপকে 'সোনার ছেলে' হাওড়ার অচিন্ত্য

পেটভর্তি জল খেয়েই মাঠে নামছে বছর তেরোর এক কিশোর। মাথায় তুলে নিচ্ছে ভারি ধানের বোঝা। তারপর তপ্ত রৌদ্রে হাঁটা লাগাচ্ছে মাঠের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। সারাদিন এই হাড়-ভাঙা খাটুনির পর মিলবে সামান্য জলখাবার এবং ডিমসিদ্ধ।

না, কোনো সিনেমার পটভূমি নয়। এই গল্প বাস্তবের। এই কঠিন বাস্তবের সঙ্গে কিশোরবেলা থেকে লড়াই চালিয়ে আসছেন অচিন্ত্য। হ্যাঁ, ভারোত্তোলক অচিন্ত্য শিউলির কথাই হচ্ছে। গতকাল রাতে ফের ভারতের পতাকা উড়ল বার্মিংহামে (Birmingham Commonwealth Games)। কমনওয়েলথের গেমসের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্য। তাঁর গলায় ঝুলছে সোনার পদক। শুধু সোনা-জয়ই নয়, পুরুষদের ৭৩ কেজি বিভাগে ৩১৩ কেজি ওজন তুলে গেমস রেকর্ড তৈরি করেন হাওড়ার দেউলপুরের অ্যাথলিট। প্রথমে স্ন্যাচ বিভাগে ১৪৩ কেজি ভারোত্তোলন করেন। পরবর্তী ক্লিন অ্যান্ড জার্ক বিভাগে তোলেন ১৭০ কেজি ওজন। 

আজ থেকে ঠিক ১১ বছর আগের কথা। দাদা অলোক শিউলির হাত ধরে স্থানীয় প্রশিক্ষক অষ্টম দাসের কাছে ভারোত্তোলনের প্রশিক্ষণ শুরু করেন অচিন্ত্য। দুই ভাই একইসঙ্গে কোচিং নিতেন সেখানে। অবশ্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র বলতে যা বোঝায়, অষ্টম স্যারের কোচিং সেন্টারের সঙ্গে একেবারেই তার মিল নেই কোনো। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁরও। কখনও দিন-মজুরির কাজ, মিলে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে হাড়ভাঙা খাটুনি— এভাবেই দিন চলে তাঁর। থাকার জায়গা বলতে ছোট্ট দুটো ঘর। ফলে প্র্যাকটিস হত গাছের তলায়। বৃষ্টি হলেই বন্ধ হয়ে যেত ক্লাস। জং ধরা আয়রন বার। তাতে কখনও হাতও ছড়ে যেত অনুশীলন করতে গিয়ে। বাবা ছিলেন সামান্য ভ্যানচালক। ফলে, উপযুক্ত পরিকাঠামোযুক্ত প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অনুশীলনের কথা চিন্তা করাও ছিল সোনার পাথরবাটি। সেখানে দাঁড়িয়ে অষ্টম স্যার কোচিং দিতেন বিনামূল্যে। 

এই লড়াই-ই আরও কঠিন হয়ে ওঠে বছর দুয়েক বাদে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন তাঁর বাবা। বলতে গেলে, পথে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল দুই ভাইকে। আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছিল অভাবের দেওয়াল। গ্রামবাসীদের থেকে ধার নিয়েই বাবার শেষকৃত্য সারতে হয়েছিল অলোক-অচিন্ত্যকে। তারপর পরিবারের হাল ধরতে হয় দুই ভাইকে। মায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে শাড়িতে জরি বসানোর কাজ করতেন শিউলি-ভাতৃদ্বয়। দিনের বেলায় সামান্য ডিমসিদ্ধের জন্য মাঠে মাঠে মুটের কাজও করেছেন তাঁরা। 

তবে এত কিছুর পরেও লড়াই থামেনি অচিন্ত্যর। বরং জেদ চেপে গিয়েছিল আরও। ২০১৩ সালেই দুই ভাই-ই একসঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় গেমসে। অচিন্ত্য ছিনিয়ে আনেন ব্রোঞ্জ পদক। অবশ্য তখন তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি কেউ-ই। বছর দুয়েক বাদে ২০১৫ সালে অচিন্ত্য অংশ নিয়েছিলেন পুনেতে সেনাবাহিনীর মিটে। নেপথ্যে দেউলপুরের গ্রামেই সেই অষ্টম স্যার। গ্রাম থেকে খান পাঁচেক তরুণ শিক্ষানবিসকে নিয়েই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন দক্ষিণ-ভারতে। সেই পুনে-অভিযানই বদলে দেয় অচিন্ত্যর ভাগ্য। ভারতীয় সেনার নজর কাড়েন খুদে প্রতিভা। 

এরপরে আর প্রশিক্ষণের জন্য ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। আর্মি স্কুলে পড়াশোনার যেমন সুযোগ পেয়েছেন, তেমনই পেয়েছেন খেলাধুলো অনুশীলন করার পরিকাঠামো। তার ফলাফলও মেলে হাতে নাতে। ২০১৫ সালেই যুব কমনওয়েলথে রুপো আনেন অচিন্ত্য। ২০১৭-র যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিল্পেও রুপো। ২০২১ সালে কমনওয়েলথ ওয়েটলিফটিং-এ এই পদকই বদলে গিয়েছিল সোনাতে। এবার বার্মিংহামেও যেন পুনরাবৃত্তি হল তার। 

বয়স মাত্র ২০ বছর। তাতেই প্রাপ্তবয়স্কদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ২টি স্বর্ণপদক ঝুলিতে পুরেছেন বাংলার তরুণ। ফলে, আগামীদিনে ভারতের অন্যতম তারকাদের মধ্যে একজন হয়ে উঠবেন অচিন্ত্য, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে বার্মিংহামে সোনা পেলেও, খুব একটা খুশি নন তিনি। কারণ গেমস রেকর্ড তৈরি করলেও, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের ব্যক্তিগত রেকর্ড ভাঙতে পারেননি তিনি। সেখানেই থেকে গেছে আক্ষেপ। তাঁর কথায়, এই লড়াই ছিল নিজের সঙ্গে। 

অচিন্ত্যর এই পরিশ্রম, অধ্যবসায়, একাগ্রতা অবাক করার মতোই। অবাক করে, তাঁর এই সোনার কেরিয়ারে তাঁর দাদা কিংবা প্রশিক্ষক অষ্টম দাসের মতো চরিত্রদের অবদানও। অভাব অনটনকে ঠেকিয়ে রেখে, পরিকাঠামো ছাড়াই যিনি বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন তরুণ প্রতিভাদের। দিন-মজুরের কাজ করেও পাঠ দিচ্ছেন তাঁদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখার। এই গল্প সিনেমার থেকে কোনো অংশে কম নাকি? 

Powered by Froala Editor

More From Author See More